ছবি: সংগৃহীত।
সেমাই ছাড়া ঈদ কল্পনাই করা যায় না। ঈদে প্রতিটি ঘরেই আয়োজন করা হয় নানা রকমের সেমাই। কেউ করেন দুধে ভেজা সেমাই, কেউ বানান ঝরঝরে সেমাই, কেউ আবার সেমাইয়ের জর্দাসহ নানা পদ তৈরি করেন। কিন্তু ঈদের সঙ্গে সেমাইয়ের যোগসূত্র কীভাবে তৈরি হলো? আর কবে থেকে শুরু হলো ঈদে সেমাই খাওয়ার প্রচলন?
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঈদের সাথে সেমাইয়ের এই যোগসূত্র কিন্তু খুব বেশিদিনের পুরনো নয়। ইতিহাসবিদদের মতে, গত শতক থেকেই ঈদে ঘরে ঘরে সেমাই তৈরির এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। খবর বিবিসির।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে আমি দেখেছি ঈদে সেমাই খাওয়ার প্রচলনটা খুব বেশিদিনের পুরনো নয়। উনিশ শতকের দিক থেকে শুরু হয় ঈদের প্রধান মিষ্টান্ন হিসেবে সেমাই খাওয়া প্রচলন।’
তিনি বলেন, ‘আনুমানিক ৩০-৪০ দশক থেকে উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা পায় সেমাই। প্রথমদিকে হাতে তৈরি সেমাই কিছুটা ব্যবসায়িকভাবে বিক্রির জন্য তৈরি হতো। পঞ্চাশ দশকের দিকে যে সেমাই তৈরি হয় সেটিই মূলত এখন আমরা সেমাই হিসেবে চিনি।’
>> সেমাইয়ের ইতিহাস-
সেমাইয়ের ইতিহাস ঘাঁটলে, মুঘল কিংবা তার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে সেমাইয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
মধ্যযুগের সাহিত্যে অনেক খাবারের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সেমাইয়ের নাম কোথাও নেই।
অর্থাৎ সেমাইয়ের প্রচলন কবে কীভাবে এই উপমহাদেশে শুরু হলো ঈদের সাথে সম্পর্কটা কীভাবে তৈরি হলো তার হদিস পাওয়াটাও বেশ মুশকিল।
গ্রিকদের সেমাইয়ের মতো দেখতে খাবার রয়েছে ঠিকই কিন্তু তা উপমহাদেশের সেমাইয়ের মতো নয়।
বাংলা অভিধানে সেমাই শব্দটাকে কোথাও বলা হয়েছে হিন্দি, কোথাও বলা হয়েছে দেশি।
ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার বইয়ে লিখেছেন, ‘গ্রিক শব্দ সেমিদালিস থেকে সেমাই শব্দের উৎপত্তি’।
তবে ‘সেমাই শব্দের উৎপত্তি’র ব্যাপারটা কিন্তু সরাসরি ঘটেনি। সেমিদালিস শব্দের মূল অর্থ হলো ময়দা। যদিও ময়দা ফারসি শব্দ।
কিন্তু এই সেমিদালিস শব্দ সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করে সমিদা রূপ ধারণ করে। সমিদা থেকেই তৈরি হয় সেমাই, সেমিয়া ইত্যাদি শব্দ।
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের মধ্য দিয়ে গ্রিসের সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটে।
সেই সময় খাদ্যদ্রব্য হিসেবে সেমিদালিস বা ময়দার সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটেছে বলে উল্লেখ করে থাকেন ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সেমাই শব্দের বুৎপত্তি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছেন-সেমাই শব্দের গায়ে গ্রিসের গন্ধ থাকলেও সেমাই দ্রব্যটা আসলে ভারতীয়।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাতে সেমাইয়ের নাম একেক রকমের।
বাংলায় সেমাই। হিন্দি, উর্দু ও পাঞ্জাবিতে সেমিয়া অথবা সেভিয়াঁ। মারাঠিতে বলে সেমাইয়া, গুজরাটিতে সেই এবং তেলেগু, তামিল ও মালায়লামে সেমিয়া।
আরো পড়ুন: ঈদে খাবার বেশি খেয়ে অস্বস্তিতে ভুগলে যা করবেন
ভারতের অনেক রাজ্যেই সেমাই নানাভাবে খাওয়া হয়। অনেক অঞ্চলে নামকিন সেমাইয়া হয় যেটা নোনতা স্বাদের হয়।
আবার অনেক অঞ্চলে হয় সেমিয়া সেভিয়াঁ যেটা মূলত সেমাইয়ের ক্ষীর, মানে এটা খেতে মিষ্টি।তবে বাংলাদেশের সেমাইয়ের স্বাদ একটাই-আর তা হলো মিষ্টি।
এই সেমাই আবার ভিন্ন নামে আছে গ্রিসে। আছে আফ্রিকার সোমালিয়াতেও। সেখানে তার নাম কাদ্রিয়াদ।
বাংলাদেশে শুধু ঘি দিয়ে ভেজে যেভাবে দমে সেমাই রান্না হয়, সোমালিয়ার কাদ্রিয়াদ রান্নার প্রণালি সেই একই রকম। সেমাইয়ের কাছাকাছি কিছু পদ পাওয়া যাবে ইরান ও তুরস্কেও। নাম অবশ্য ভিন্ন।
অনেকের ধারণা ইতালির 'ভারমিচেলি' থেকে এই উপমহাদেশে সেমাই এসেছে, যদিও এ বক্তব্যের কোনও প্রমাণাদি পাওয়া যায় না।
ঈদে সেমাই প্রচলিত হলেও আগে প্যাকেটজাত রেডিমেড সেমাই সহজলভ্য ছিল না। বাড়ির মহিলারা তখন হাতে তৈরি করতেন সেমাই। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই বাড়িতে বাড়িতে সেমাই তৈরি শুরু হয়ে যেত। ময়দা দিয়ে বা চালের আটা দিয়ে সেমাই তৈরি হতো। এই সেমাইয়ের প্রচলন এখনও আছে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে।
সময়ের আবর্তনে আস্তে আস্তে প্যাকেটজাত সেমাই সহজলভ্য হলো বাংলাদেশে। সেমাইয়েরও রকমফের পাওয়া যায় বাজারে।
সেমাই কেন বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা পেলো, সে প্রশ্নের জবাবে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেন, ‘দ্রুত তৈরি করা যাচ্ছে, দামে অপেক্ষাকৃত সস্তা। ফলে এটা একটা অনুষঙ্গ হয়ে গেছে। এই যেমন- পোলাও, কোর্মা, সেমাই।’
তিনি বলেন, ‘সেমাইয়ের ইতিহাস তেমন একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার একে বহিরাগত খাবারও বলা যাবে না। ভারতীয় উপমহাদেশের পিঠা-পুলি বানানোর পদ্ধতিই পরিবর্তিত হয়ে আস্তে আস্তে আজকের সেমাইয়ের রূপ নিয়েছে।’
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানে ঈদে সেমাই খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে তবে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে ঈদে সেভাবে সেমাই খাওয়া হয় না।
এমএইচডি/ আইকেজে
খবরটি শেয়ার করুন