বুধবার, ১৭ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২রা শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজ দোপ্পা দিবস : পোশাকের মাধ্যমে চীনের নির্যাতনের প্রতিবাদ উইঘুর মুসলমানদের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন, ৫ই মে ২০২৩

#

বিশেষ টুপি দোপ্পা পরে চীনের নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায় উইঘুর মুসলমানরা: ছবি- সংগৃহীত

একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা আপনার বাড়িতে ঢুকে প্রিয়জনদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের রাখা হচ্ছে ক্যাম্পে। সন্তানদের ধরে নিয়ে রাখা হচ্ছে ক্যাম্পে। এ অবস্থা চীনের উইঘুর সম্প্রদায়ের।

উইঘুর মুসলমানদের ওপর চলা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ 'দোপ্পা' টুপি। দোপ্পা এমনই এক পরিচ্ছদাংশ যা চীনের উইঘুর মুসলিমরা তাদের ওপর নির্যাতন, গণহত্যার প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছে।

প্রতিবছর   মে মাসের ৫ তারিখ উইঘুর মুসলিমরা দোপ্পা দিবস পালন করে। উইঘুররা তাদের ঐতিহ্যবাহী দোপ্পা পরিধানকে সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করেছিল৷ পরবর্তীতে  চীন সরকার ডোপা পরিধান নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদস্বরূপ ৫ই মে কে "দোপ্পা দিবস" হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উইঘুররা তাদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের অংশ হিসাবে এবং চীনাদের দ্বারা তাদের স্বদেশে ঔপনিবেশিকতা, গণহত্যা এবং দখলের প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতীকী জাতীয় প্রতিরোধের অংশ হিসাবে মাথায় দোপ্পা পরিধান করে।

জিনজিয়াংয়ে স্থানীয় আইন পরিবর্তন করে শিক্ষা শিবিরের ‘চরমপন্থী মতাদর্শিক শিক্ষা’ বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়েছে চীন। বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এসব শিবিরে বন্দীদের মান্দারিন ভাষা শিখতে বাধ্য করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির প্রশংসার কথা বলা এবং তাদের সঠিক আচরণ পরিচালনার নিয়মগুলো কঠোরভাবে মনে রাখতে বাধ্য করা হয়। এ অভ্যাসগুলোর অংশ হিসেবে চীন সরকার সাংঘর্ষিকভাবে জিনজিয়াংয়ের উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই শিক্ষাশিবিরের পাশাপাশি উইঘুর শিশুদের ক্যাম্প ও স্কুল রয়েছে, যেখানে তাদের পরিবার, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে ফেলা হয়।

দোপ্পা কি? 

দোপ্পা মধ্য এশিয়ায় উদ্ভূত একটি বর্গাকার এবং কখনও কখনও গোলাকার স্কালক্যাপ। হাজার হাজার বছর ধরে, দোপ্পা প্রাথমিকভাবে মধ্য এশিয়া জুড়ে তুর্কি জনগণ এবং সেলজুক তুর্কিরা পরিধান করত যারা আনাতোলিয়ায় (আধুনিক তুরস্ক) স্থানান্তরিত হয়ে বসতি স্থাপন করেছিল। আজ দোপ্পা প্রধানত উইঘুর, উজবেক, তাতার [রাশিয়ান ফেডারেশনের তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রে] এবং তাজিকদের দ্বারা পরিধান করা হয়।

দোপ্পা উৎসবের সূচনা

তাহির ইমিন নামক একজন তরুণ উইঘুর কর্মী যিনি পেশায় ছিলেন সাংবাদিক এবং প্রাক্তন রাজনীতিবিদ, ২০০৯ সালে দোপ্পা পরিধানকে উৎসবের রূপ দান করেন৷ এই উৎসবটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী উরুমকিতে। ২০১১ সালে এই উৎসব মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়৷ এর জনপ্রিয়তা  ছড়িয়ে পড়তে থাকে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে।

পটভূমি

১৯৪৯ সালে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কিছু দিন পর কমিউনিস্ট সরকার উইঘুরদের বৃহত্তর চীনের সাথে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব নাকচ করে দিলে শুরু হয় নির্যাতন, নেমে আসে বিভীষিকাময় অত্যাচার। কমিউনিস্টরা অস্ত্রের জোরে জিনজিয়াং দখল করে নেয়। তখন উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াংকে দৃশ্যত স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। কিন্তু থেকে থাকেনি নির্যাতন। জিনজিয়াং দখলের পর থেকে উইঘুরদের ওপর নির্যাতন, হত্যা চলতেই থাকে৷ ১৯৯০ সালের বারেন বিপ্লবসহ বেশ কয়েকবার উইঘুররা চীনা সৈন্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে৷ ২০০৯ সালে তাহির ইমিন ডোপা উৎসবের সূচনা করলে দোপ্পাকে চীনের স্বৈরাচারিতা, বর্বরতার প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে প্রকাশ করা হয়।

চীনা সরকারের প্রতিক্রিয়া

দোপ্পা উৎসবের শুরুর দিকে চীনা সরকার উৎসবটিকে সমর্থন করে৷ বেইজিংয়ে সেন্ট্রাল চায়না টিভি (সিসিটিভি) উৎসবটি সম্প্রচারও করেছে। ২০১১ সাল নাগাদ উৎসবটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং দেশের বিভিন্ন  অংশে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ। এমনকি ইয়াকান (শাচে) কাউন্টি এবং কাশগড় প্রিফেকচারের স্থানীয় সরকার দ্বারা দোপ্পা উৎসবের উপর একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।

কিন্তু পরবর্তীতে চীনা কর্তৃপক্ষ দোপ্পা উৎসব পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দোপ্পাকে অদ্ভুত পোশাক ও দোপ্পা পরিধানকারীকে চরমপন্থী হিসেবে  আখ্যায়িত করে। স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের দোপ্পা পরিধান একেবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷ কেউ দোপ্পা পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে তাকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়৷ এইভাবে চীনা কর্তৃপক্ষ পূর্ব তুর্কিস্তানে জাতিগত সম্পর্ক উন্নয়নের উছিলায় উইঘুরদের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি এবং বিনিময়কে বাধা দেয়।

"বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান"

উইঘুর দোপ্পা দিবসের প্রাক্কালে, নির্বাসিত পূর্ব তুর্কিস্তান সরকারের নির্বাহী পরিষদ একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, "দোপ্পা পূর্ব তুর্কিস্তানি/উইঘুর জাতীয় পরিচয় প্রকাশের একটি প্রতীকী কিন্তু সরল উপায়, পূর্ব তুর্কিস্তান সরকার নির্বাসন উইঘুর এবং অন্যান্য পূর্ব তুর্কিস্তানিদের প্রতিদিন তাদের দোপ্পা পরতে উৎসাহিত করেছে। দোপ্পা মূলত উইঘুর এবং অন্যান্য তুর্কি জনগণের অনন্য সংস্কৃতি, জাতীয় পরিচয় এবং অস্তিত্বকে মুছে ফেলার জন্য চীনের প্রচেষ্টার প্রতিরোধের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে।"

আরো পড়ুন: ওআইসির সভায় সুদানে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান বাংলাদেশের

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, "নির্বাসিত পূর্ব তুর্কিস্তান সরকার তাদের বন্ধু, সমর্থক এবং উইঘুরদের প্রতি সহানুভূতিশীল সকলকে পূর্ব তুর্কিস্তান এবং এর জনগণের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে দোপ্পা পরতে উৎসাহিত করে, বিশেষ করে ৫ মে - দোপ্পা দিবসে৷

গত বছর, উইঘুর জনগণের অধিকারের জন্য প্রচারণা চালানো "Stop Uyghur Genocide "নামক একটি   লন্ডন-ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থার  আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময়, উইঘুর সম্প্রদায় কিছু নেতৃস্থানীয় ব্রিটিশ সমর্থকদের কাছে দোপ্পা উপস্থাপন করেছিল। হংকং ওয়াচের সিইও বেনেডিক্ট রজারকে লন্ডনের একটি সমাবেশে দোপ্পা পরা অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। তিনি গর্বিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, তিনি উইঘুর জনগণের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রদর্শনের জন্য ঐতিহ্যবাহী উইঘুর পোশাক পরেছেন।

উইঘুর মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে  বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে ৫ই মে  পালিত হয় দোপ্পা দিবস। দিবসটি উদযাপন স্পষ্টভাবে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপকে সহজতর করেছে। স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে দোপ্পা নিষিদ্ধ করা চীনের ইচ্ছাকৃত নীতি উইঘুর জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। তারা আশঙ্কা করছে যে চীনা সরকার তাদের ঐতিহ্যবাহী উইঘুর সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে রয়েছে।

নিউজটি ইউটিউবে দেখুন লিঙ্ক-

এমএইচডি/ আইকেজে 

উইঘুর মুসলমান ডোপা উৎসব ইতিহাস

খবরটি শেয়ার করুন