ফাইল ছবি (সংগৃহীত)
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজো। কৈলাশ থেকে ঘোড়ায় চড়ে পৃথিবীতে অবস্থান করেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপ দেবী দুর্গা। হিন্দুধর্মে দেবী দুর্গার স্বরূপের বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। দেবী আরাধনা ও উৎসবের আমেজে আসুন জেনে নিই সেই স্বরূপের প্রকৃত অর্থ।
পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যা দেবী দুর্গা। তিনি সৃষ্টির আদিশক্তির স্বরূপ। তিনিই দেবাদিদেব মহাদেবের শান্ত স্ত্রী পার্বতী। কিন্তু যখন ধর্ম আর অধর্মের লড়াই শুরু হয় তখন এই শান্ত পার্বতীই শক্তির প্রতীক দুর্গারূপ ধারণ করে অধর্মকে বিনাশ করে। তাই জগতে শান্তির জন্য দেবী দুর্গা পূজিত হয়ে আসছে।
পুরাকালে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দুর্গম নামের এক অসুরকে হত্যা করেন দেবী। তখন মহাদেব তার নামকরণ করেন দুর্গা। এই দুর্গাই পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারী মহিষাসুররূপী পাপী ব্যক্তিদের বিনাশ করতে ধরাধামে নেমে আসেন।
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পুরাণ মতে, মহিষাসুরকে বধে দেবী দুর্গার সেই শক্তিকে পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত করতে সকল দেবতা ধ্যানমগ্ন হয়ে দেবীর আরাধনা করেছিলেন। এরপর দেবী সেই আরাধনায় সাড়া দিলে দেবতারা একে একে নিজের অস্ত্র তুলে দেন দেবীর হাতে। মূলত রূপক অর্থে সকল দেবতার অস্ত্রই হলো তাদের সঞ্চিত জ্ঞানের প্রতীক।
শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে, নারী শক্তির প্রতীক দেবী দুর্গার তিন চোখ ও ১০ হাত মূলত একটি রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে দেবীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যেমন-
আরো পড়ুন : পুজোয় কী ধরনের জুতো পরবেন
পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পুরাণে বলা হয়েছে, দেবীর তিনটি চোখের বাম চোখ বাসনা বা চন্দ্রের প্রতীক। ডান চোখ কর্ম বা সূর্যের প্রতীক। আর কপালের কেন্দ্রীয় চোখ জ্ঞান বা অগ্নির প্রতীক।
দেবী দুর্গার ১০ হাতেরও ব্যাখ্যা রয়েছে ধর্মগ্রন্থে। রূপক অর্থে দেবীর ১০ হাতে রয়েছে তার ১০টি অস্ত্র। এ সব অস্ত্রেরই রয়েছে নানা প্রতীকী অর্থ। যেমন-
১। চক্র: শ্রীবিষ্ণুর দেয়া চক্র দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক। দেবী দুর্গার হাতে চক্র থাকার অর্থ সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রে অবস্থান করছেন দেবী।
২। ত্রিশূল: দেবাদিদেব মহাদেব দুর্গাকে তার ত্রিশূল দান করেছিলেন। এই ত্রিশূলের তিনটি ফলা মানুষের তিনটি গুণ সত্ত্ব, তমঃ, রজঃ -এর প্রতীক।
হিন্দুধর্মের পবিত্র গ্রন্থ গীতায় বলা হয়েছে, সত্ত্ব মানে ধর্ম জ্ঞান, রজঃ মানে অহঙ্কার এবং তমঃ মানে অন্ধকার। এই তিনটি গুণের সমন্বয়ে সমস্ত মানুষের সৃষ্টি। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষ এই তিনটি গুণের এক বা একাধিক নিয়ে সৃষ্টি। আর এই তিনটি গুণের প্রতীকী রূপই হলো দেবাদিদেব মহাদেবের ত্রিশূলের তিনটি ফলা।
৩। শঙ্খ: দেবতা বরুণের দেয়া শঙ্খ অহংকারের প্রতীক। এ শঙ্খের ধ্বনিতে স্বর্গ, মর্ত্য ও নরকজুড়ে থাকা সব অশুভ শক্তি ভীত ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪। বজ্র: দেবতা ইন্দ্রের দেয়া বজ্র সংকল্পের দৃঢ়তা ও সংহতির প্রতীক। এই দুই গুণের মাধ্যমেই নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যাবার ইঙ্গিত দেন দেবী।
৫। গদা: যমরাজের দেয়া গদা ‘কালদণ্ড’ নামেও পরিচিত। এই অস্ত্র আনুগত্য, ভালোবাসা এবং ভক্তির প্রতীক।
৬। তীর ধনুক: দেবতা পবন দুর্গাকে তীর ধনুক দান করেন। এই অস্ত্র ইতিবাচক শক্তির প্রতীক।
আরো পড়ুন : পূজার উৎসবে বাড়িতেই বানান স্বাস্থ্যকর কিছু মিষ্টি
৭। খড়গ/তলোয়ার: ভগবান গণেশ মা দুর্গাকে তলোয়ার দেন। এ তলোয়ার বুদ্ধির প্রতীক। যা দিয়ে সমস্ত বৈষম্য ও অশুভকে বিনাশ করা যায়।
৮। ঘণ্টা: দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত মা দুর্গাকে দান করেছিলেন ঘন্টা। এর ধ্বনি অশুভ শক্তির বিনাশের ইঙ্গিত দেয়।
৯। পদ্ম: দেবতা ব্রহ্মা দেবী দুর্গাকে পদ্ম ফুল দান করেন। এ পদ্ম জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক চেতনার উত্থানের প্রতীক।
১০। সাপ/ নাগপাশ: পুরাণ মতে, শেষ নাগ দেবীকে একটি সাপ দান করেন। এই সাপ শুদ্ধ চেতনার প্রতীক।
এই দশ অস্ত্রের সর্বশক্তি দিয়ে দেবী দুর্গা দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। পৃথিবীতে দশ অস্ত্রের এসব শুভ শক্তির প্রতীক যেন ভক্তদের মাঝেও অধিষ্ঠিত হয়ে ওঠে এবং মানুষ যেন পৃথিবীর অশুভ শক্তির বিনাশ করতে পারে তাই প্রতি বছর দেবী পক্ষের তিথিতে দেবী দুর্গার শক্তি পৃথিবীতে উপস্থিত হয়। আর তখনই দেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে মর্ত্যবাসীরা।