বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধ্রুপদী সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ওস্তাদ রশিদ খান

বিনোদন ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ন, ১০ই জানুয়ারী ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন শাস্ত্রীয় সংগীতের কিংবদন্তীগণ। তাদের তৈরি সুরের মূর্ছনায় বিশ্ব আলোড়িত হয়েছে।  সেরকম একজন সংগীতজ্ঞ, শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ও খেয়াল গায়ক হলেন উস্তাদ রশিদ খান। উত্তর প্রদেশে বরেলীর কাছে এক বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার শাকিল বাদাঁয়ুর নামে রয়েছে একটি গ্রাম। এই গ্রামেই উস্তাদ রশিদ খান জন্ম নেন। তার পিতা হামিজ রেজা খান ছিলেন সংগীতজ্ঞ আর মা শাখরী বেগম ছিলেন গৃহিণী।

রশিদ খান যে পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস ও তাৎপর্য বিবেচনায় সেই পরিবারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই পরিবারেই জন্ম নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনকারী শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীরা। শুধু তা-ই নয়, তাদের নিজস্ব সঙ্গীত ঘরানা ছিল। “রামপুর-সহসওয়ান” নামের এই বিখ্যাত ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আরেক বরেণ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ এনায়েত হুসেন খান। রশিদ খানের চাচা উস্তাদ গোলাম মুস্তফা খানও সংগীতশিল্পী ছিলেন। তাই ছোটবেলাতে পরিবার থেকেই তার সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়। প্রথমে বাবা হামিজ রেজা খানের কাছে এবং পরবর্তীতে দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবের কাছে তার প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা সম্পন্ন হয়।

ছোটবেলাতে তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল আর দুরন্ত প্রকৃতির। গানের নিয়মিত চর্চার চেয়ে ফুটবল খেলাতেই ছিল তার বেশি মনোযোগ। কিন্তু তার দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কঠোর নিয়মকানুন আর অনুশাসনে নিয়মিত চর্চা করতে হত তার। তিনি নিজেই ছোটবেলায় তার কঠোর সংগীতচর্চা সম্পর্কে বলেছেন,

“ওই ছোট বয়সে সবসময় গানবাজনা ভাল লাগত না। মন পড়ে থাকত ফুটবল, ক্রিকেটে। বর্ষায় কাদা মেখে ফুটবল খেলে এসে রেওয়াজে বসে পড়তাম। রেওয়াজে বসতে দেরি করলেই বকাবকি অবধারিত। রামপুর সহসওয়ান সঙ্গীত ঘরানাটা বেশ কঠিন। এর বৈশিষ্ট্য হলো মধ্যম নিচু লয়, মুক্ত কণ্ঠ ও জটিল তাল। একটা তান নিয়ে সারা দিন ধরে রেওয়াজ করে চলেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যতক্ষণ পর্যন্ত সুরটা ঠিক জায়গায় লাগছে, ততক্ষণ চলত রেওয়াজ।”

মাত্র এগার বছর বয়সে রশিদ খান মঞ্চে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপরের বছর ১৯৭৮ সালে দিল্লীতে আই টি সি সঙ্গীত সম্মেলনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবং অতি অল্প বয়সেই তার সঙ্গীত গায়কী সকলকে আকৃষ্ট করে। ১৯৮০ সালে তিনি দাদুর হাত ধরে কলকাতা আই টি সি সঙ্গীত একাডেমিতে আসেন এবং এখানেই তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে তিনি পরিপূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।

এই সময়ই তিনি ভালবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আসামের গুয়াহাটি নিবাসী জয়িতার সাথে। ব্যক্তিগত জীবনে উস্তাদ রশিদ খান দুই মেয়ে এবং এক ছেলের পিতা। মেয়ে সুহা এবং শাওনা দুজনেই সঙ্গীত জগতে আত্মপ্রকাশ করেছেন পিতার পথ ধরে। মেয়েদের বাইরে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক সকল সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের সামনে এগিয়ে যেতে সতত অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যান তিনি।

ছোটবেলা থেকেই অভাবনীয় পারদর্শিতা আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়নে মেধার দ্যুতিময়তার কারণে বহু বিখ্যাত ও প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞের আশীর্বাদ লাভ করেন তিনি। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী মুক্তকণ্ঠে তাকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে দ্বিধাবোধ করেন নি। পাশাপাশি উস্তাদ রশিদ খানের গুণমুগ্ধ ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর স্বয়ং। রশিদ খান এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন,

“পণ্ডিত রবিশঙ্করজির সঙ্গে আমার একসময় এক মঞ্চে অনুষ্ঠানের সুযোগ আসে। পণ্ডিত রবিশঙ্করজি আমাকে প্রচুর উৎসাহ ও আশীর্বাদ দেন। পণ্ডিত ভীমসেন যোশীও আমায় ভীষণ স্নেহ করতেন এবং একসঙ্গে অনুষ্ঠান করার সৌভাগ্যও হয়েছে আমার।”

গায়কী বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে উস্তাদ রশিদ খান একজন অনন্যসাধারণ শিল্পী। তিনি মূলত রামপুর সহসওয়ান ঘরানার হলেও ঘরানাকেন্দ্রিকতা কখনোই তাকে আটকে রাখেনি। তাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার চমৎকারিত্ব তার কণ্ঠে মিলে মিশে ধারণ করেছে এক মোহনীয় রূপ।

মূলত রামপুর সহসওয়ান ঘরানার সাথে আরেক স্বনামধন্য গোয়ালিয়র ঘরানার সাথে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পূর্ণ গম্ভীর স্বর ও সুর, মধ্য এবং ধীর লয়ের সঙ্গীতে তান ও বিস্তারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকার্য এই ঘরানাকে দিয়েছে আলাদা মাত্রা। কিন্তু এর পাশাপাশি উস্তাদ রশিদ খান বিলম্বিত খেয়াল গায়নে তার দাদুর কাছ থেকে শেখা ব্যতিক্রমধর্মী গায়কীর সাথে সরগম ও সরগম তানকারীর মিশেল ঘটিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তার প্রতিভার চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, তিনি ইন্দোর ঘরানার প্রবাদপুরুষ উস্তাদ আমির খাঁ ও শাস্ত্রীয় সংগীতের আরেক প্রাণপুরুষ পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গায়কীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তার গায়কীতে এই দুই মহারথীর প্রভাবও সুস্পষ্ট। এভাবেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তোর মতো সকল অনন্য গায়নরীতিকে নিজের মতো করে তিনি একত্র করে সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য সঙ্গীত মূর্ছনার। আর ঠিক এখানেই কেবলমাত্র একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে শুধু নয়, উস্তাদ রশিদ খান হয়ে উঠেছেন মালবকৌশিকের বজ্জুর সময় থেকে চলে আসা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সমৃদ্ধতম ধারক ও বাহক।

শুধু খেয়াল নয়, তারানাতেও তিনি তার অনবদ্য পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেছেন। দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন থেকে প্রাপ্ত তারানা গায়নে অনন্য শৈলীকে তিনি নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত করার মাধ্যমে তিনি তার পরিবেশিত প্রতিটি তারানাকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়।

তার গায়কীর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের চলন অনুযায়ী কঠোর নিয়মের বাঁধনে আবদ্ধ করে সুরকে নিয়ে শুধু খেলাই করেন না, পাশাপাশি বন্দিশ কিংবা আলাপের সময় আবেগের স্নিগ্ধ স্পর্শ দিয়েও সঙ্গীতকে স্পর্শ করেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কেবলমাত্র কঠিন নিয়মের বেড়াজালে থেকে সুরের কারুকার্যের সেই প্রাচীনত্বকে এভাবে বদলে দিয়েছেন উস্তাদ রশিদ খান।

এর পাশাপাশি ভাবগাম্ভীর্যময় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে অন্যান্য লঘু সঙ্গীত ধারার সাথে মিশিয়ে তিনি বেশ কিছু চমৎকার গবেষণাধর্মী সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। আমীর খুসরোর “নায়না পিয়া সে” গানটিকে তিনি সুফি ঢঙ্গে গেয়েছেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের এক নতুন ধারার সৃষ্টি করতে লুই ব্যাংকসের সাথে যুগলবন্দী করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মানুষ হলেও তিনি বেশ কিছু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। নচিকেতার সাথে গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ কিছু যুগলবন্দী। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানগুলোর তালিকা-

Sakhi ri (2017) – Vodka Diaries

Jheeni Re Jheeni (2013) – Issaq

Aiyo Piyaji (2012) – Chakravyuh

Poore se zara sa (2011) – My name is khan

Alla hi rahem (2010) – Allah hi rahem

Aaoge jab tum Saajana (2007) – Jab We Met

 শুধু সঙ্গীতে এই অসাধারণ সাফল্যেই তিনি থেমে থাকেননি। তিনি নিজের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন শাখরী বেগম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এক সঙ্গীত গ্রাম তৈরির। যেখানে সকলে সঙ্গীতের উদার বাণীতে দীক্ষা নেবে। হিংসা-দ্বেষ আর সকল হানাহানির অবসান ঘটিয়ে সঙ্গীতের মাধ্যমে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেবে সেই গ্রামের প্রতিটি মানুষ- এটাই তার আশা ছিল।

সঙ্গীতের জাদুকর এই মানুষটি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে গিয়ে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলাদেশে এসেছেন বেশ কয়েকবার। প্রতি বছর ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবে যোগ দিতেও তিনি আসেন। 

সর্বদা বিনয়ী, নীতিবান ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষটি সঙ্গীতচর্চার পাশাপাশি একটি সুস্থ সমাজ গঠনের স্বপ্নে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের প্রতিনিয়ত সঙ্গীত সাধনা করে যেতে তাই তিনি সর্বদা উৎসাহিত করেছেন। পাশাপাশি একজন আদর্শ সামাজিক ও উদার মানুষ হিসেবে সবার উপরে তিনি জোর দিয়েছেন আদর্শ মানুষ হিসেবে নিজেকে গঠনের উপর। তিনি বলে গেছেন-

“ভাল গান গাইতে শেখার আগে ভাল মানুষ হও। মনকে উদার করতে শেখো। হৃদয় যার উন্মুক্ত নয়, উন্মুক্ত সুর তার কণ্ঠ থেকে কিভাবে উৎসারিত হবে?”

আরো পড়ুন: বিকৃত সুরের ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ গান অপসারণের নির্দেশ

শাস্ত্রীয় সংগীতে অসামান্য অবদান রাখায় একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন রাশিদ খান। ২০০৬ সালে তিনি পদ্মশ্রী, পাশাপাশি ‘সংগীত নাটক আকাদেমি’ পুরস্কারে ভূষিত হন।

তারপর ২০১২ সালে বঙ্গভূষণ পুরস্কার, ২০১০ সালে গ্লোবাল ইন্ডিয়ান মিউজিক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস, ২০১২ সালে মহাসংগীত সম্মান পুরস্কার, ২০১৩ সালে মির্চি মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, এবং ২০২২ সালে শিল্পকলার ক্ষেত্রে ভারত সরকার কর্তৃক ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মভূষণে ভূষিত হন রাশিদ খান।

গতকাল (৯ই জানুয়ারি) বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে থেমে গেল উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী ওস্তাদ রশিদ খানের জাদুকরী কণ্ঠ। 

তার বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান রশিদ খান। তার মৃত্যুতে সংগীতের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে।

খ্যাতিমান এ শিল্পীর মৃত্যুতে শাস্ত্রীয় সংগীতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তার চিরবিদায়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে সংগীত ভুবনে।

এসি/ আই.কে.জে


ওস্তাদ রশিদ খান ধ্রুপদী

খবরটি শেয়ার করুন