কাঁঠালের বার্গার। ছবি : সংগৃহীত
সম্প্রতি ইউরোপের দেশ আইসল্যান্ড থেকে ৪ লাখ পিস কাঁঠালের বার্গারের ক্রয়াদেশ পেয়েছে বাংলাদেশ। আইসল্যান্ডের চেইন সুপারশপ আইসল্যান্ড সুপারস্টোরে রপ্তানি হচ্ছে কাঁঠালের বার্গার। পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা পিকেএসএফের আশা, প্রক্রিয়াজাত কাঁঠালের বার্গার সারা বিশ্বের নিরামিষভোজীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করবে।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর কাঁঠালের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাঁঠালের একাধিক গুরুত্ব ও খাওয়ার উপায় তুলে ধরেন। তারপর থেকেই আলোচনার সৃষ্টি কাঠলের বার্গার নিয়ে। এবার শুধু আলোচনায় নয় বাংলাদেশের রপ্তানির ঝুড়িতে যোগ হওয়া নতুন আইটেম এখন কাঁঠালের বার্গার।
এদিকে, খাদ্য বিষয়ক বিজ্ঞানীরাও কাঁঠাল থেকে তৈরি এই আধুনিক খাবারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত। মৌসুমি ফল থেকে কীভাবে আরও বেশি লাভবান হওয়া যায়, তা নিয়ে একনিষ্ঠ গবেষণার ফল এই কাঁঠালের বার্গার।
খাদ্য পরীক্ষাগারে গবেষকদের সাফল্যের পর বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠালের রেসিপি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হয় পিকেএসএফ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট) থেকে আর্থিক সহায়তাও মিলেছে। সংস্থাটি তার কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং উদ্যোগ প্রচার প্রকল্পের অধীনে ১২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করছে।
জাতিসংঘের এজেন্সি-সহায়তা প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়িত হওয়া ছোট আকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে কাঁঠালের বার্গার অন্যতম।
১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিস (সিডিআইপি) নামের এনজিওটি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পে মোট বিনিয়োগ করা হয়েছে ১.৮৯ কোটি টাকা; এরমধ্যে পিকেএসএফ দিয়েছে ১.৪৪ কোটি টাকা এবং বাকি টাকা দিচ্ছে সিডিআইপি।
সিডিআইপির নির্বাহী পরিচালক মিফতা নাইম হুদা বলেন, কাঁঠালের বার্গার উৎপাদন কারখানায় পিকেএসফ শুধু অর্থায়নই করছে না, আইসল্যান্ড থেকে যে রপ্তানি অর্ডার এসেছে, তাতেও পিকেএসএস সহায়তা করছে। আইসল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি পিকেএসএফের মাধ্যমে কারখানা পরিদর্শন করতে চেয়েছে। সিডিআইপি বিষয়টি মাথায় নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশ কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ডইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর)-এ ইতোমধ্যেই কাঁঠালের বার্গারের খাদ্যমান যাচাই করা হয়েছে। বিসিএসআইআর থেকে ডায়েটারি ফাইবার অ্যানালাইজারের মাধ্যমে পরীক্ষায় প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁঠালের পেটিতে ৯.৭৮ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১০.৮৭ গ্রাম প্রোটিন, ৮.৪৭ গ্রাম ফ্যাট, ১৯.৩২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার এবং ১৫৯ কিলোক্যালরি এনার্জি রয়েছে বলে জানা যায়।
পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, স্বাদ, গন্ধ কিংবা রসালো ভাবের দিক দিয়ে মাংসের পেটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঁঠালের পেটি। বিশ্বে ভেজিটেরিয়ানদের (নিরামিষভোজী) কাছে এর চাহিদা থাকার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে রপ্তানিতেও তৈরি হয়েছে সম্ভাবনা।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আইসল্যান্ড সুপারস্টোর বাংলাদেশকে এই কাঁঠাল আমদানির অর্ডারও দিয়েছে। বিশ্ববাজারের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও এটি জনপ্রিয় করার উদ্যোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ১৮,৯৩,৩০৩ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে এ উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, পণ্য বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে সারাবছর কাঁঠালের পণ্য বিপণন সম্ভব হবে। এতে কাঁঠালের ভ্যালু অ্যাডিশন বা মূল্য সংযোজন কয়েকগুণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাণিজ্য এবং মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রক্রিয়াজাত ফলের রেসিপিতে উদ্যোক্তা তৈরির মিশন রয়েছে পিকেএসএফের। এমন অনেক উদ্যোক্তা ইতোমধ্যেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিজেদের ব্যবসা শুরু করেছেন।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্ট হার্ভেস্ট টেকনোলজি বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্য প্রযুক্তিবিদ ড. মো. গোলাম ফেরদৌস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আমরা যেকোনো ফল বা সবজি প্রক্রিয়াজাত করলে তাতে কমপক্ষে দ্বিগুণ ভ্যালু অ্যাডিশন হয়। কিন্তু, কাঁঠালের ক্ষেত্রে ভ্যালু অ্যাডিশন বহুগুণ হতে পারে।
তিনি বলেন, কাঁঠাল সর্বগুণে গুণান্বিত একটি ফল। আমরা শুধু পাকা কাঁঠালই খাই। কিন্তু কাঁচা কাঁঠালের যে অনেক ব্যবহার আছে এবং এটি দিয়ে অনেক ধরনের পণ্য তৈরি করা যায়, তা আমাদের সাধারণ মানুষের মধ্যে অজানা। এতে আমাদের দেশের প্রচুর কাঁঠাল অপচয় হচ্ছে। এই অপচয় রোধ করতে হলে কাঁচা থাকা অবস্থায়ই এর ব্যবহার শুরু করতে হবে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই বিজ্ঞানী আরও বলেন, কাঁঠালে প্রচুর পুষ্টিগুণ রয়েছে। যে পুষ্টি অন্য ফলে পাওয়া যায় না সেটি কাঁঠালে পাওয়া যায়। কাঁঠালের ক্যালোরি ভ্যালু অনেক বেশি। এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার আছে।
তিনি বলেন, শুধু বার্গারই নয়– কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে স্যান্ডুইচ, কাঁঠালের রোল, কাটলেট, সিঙ্গারা, সমুচা, কাঁঠালের দই, কাঁঠালসত্ত্ব, শরবত, কাস্টার্ড, কেক, আইসক্রিমও তৈরি করা সম্ভব। যদি সচেতনতা তৈরি করা যায় তাহলে কাঁঠালপণ্যের একটি বড় বাজার তৈরি করা যেতে পারে এবং বিদেশের বাজারেও এটি ব্যাপক রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি করবে।
মো. গোলাম ফেরদৌস আরও বলেন, আমরা জেনেছি ম্যাকডোনাল্ড'স আমেরিকায় কাঁঠালের বার্গার বানাচ্ছে। কাঁঠাল কিন্তু আমেরিকায় খুব বেশি হয় না। শুধুমাত্র পুষ্টিগুণ এবং স্বাদ বিবেচনায় তারা কাঁঠালের বার্গার বানাচ্ছে।
কাঁঠাল থেকে তৈরি আইটেমগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু খাবারের দোকানেও দেখা যায়; যার মধ্যে মূলধারার মুদি দোকান এবং ফুড মার্কেট যেমন– ফ্রাই'স ফুড স্টোর এবং ফাইন ফুডস রয়েছে। এসব জায়গায় কাঁঠালের বারবিকিউ, রিকোটা-স্টাফড কাঁঠালের মতো খাবার তৈরি হয়। আর এসব দোকানের কাঁঠালের চাহিদা পূরণ হয় মূলত মেক্সিকো থেকে।
আরো পড়ুন : পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী
পিকেএসএফ ও সিডিআইপির কর্মকর্তারা জানান, বার্গারের পেটি তৈরিতে শতকরা ৫৮ ভাগ কাঁঠাল এবং ২০ ভাগ ময়দা/কর্ণ ফ্লাওয়ারের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ২২ ভাগ উপকরণ হিসেবে পিঁয়াজ, আদা, ধনে পাতা, কারি পাউডার, চিলি পাউডার ইত্যাদির ব্যবহার হয়েছে।
মো. ফজলুল কাদের জানান, কাঁঠারের শুধু বার্গার নয়, ফলটি দিয়ে আরও কিছু পণ্য উৎপাদের পরীক্ষামূলক কাজ চলছে।
কাঁঠালের জুসকে ম্যাঙ্গো জুসের মতো জনপ্রিয় করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কাঁঠালের জুস তৈরি করেছে পিকেএসএফ। এছাড়া মিয়ানমারে কাঁঠালের বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়। এমনকি, কাঁঠালের বিচি ক্যান্সার প্রতিরোধক, যা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত।
এসকে/
খবরটি শেয়ার করুন