সোমবার, ২১শে জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** ৪৮তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ৫২০৬ *** খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত নেতানিয়াহু *** বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক: গোপালগঞ্জে প্রশাসন চাইলে রক্তপাত এড়ানো যেত *** পাকিস্তানকে উড়িয়ে ৯ বছর পর জিতল বাংলাদেশ *** এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান হওয়ার বিষয়ে তিন দলের ভিন্ন প্রস্তাব *** এত ‘নির্দোষ, নিরপরাধ, নিষ্পাপ’ সরকার আমি দেখিনি: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য *** গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ এনে কোটালীপাড়ায় বিএনপির সংবাদ সম্মেলন *** গোপালগঞ্জে জারি করা কারফিউ ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার *** পাকিস্তানকে দাঁড়াতেই দিলেন না তাসকিনরা *** শুটিংয়ে আহত হননি শাহরুখ

বাংলাদেশে চীনের সহায়তা প্রকল্পগুলির অগ্রগতি সন্তোষজনক কী?

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৪:০৫ অপরাহ্ন, ৯ই আগস্ট ২০২৩

#

২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ চায়নার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ। চায়না গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ট্র্যাকারের মতে, বর্তমানে এ প্রকল্পে চীন প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের প্রকল্প নির্মাণে জড়িত। ২০১৬ সালে নেপাল সফরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই প্রকল্পে যে অর্থ ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বর্তমান নির্মাণ প্রকল্প ব্যয় তার এক-তৃতীয়াংশ। 

আট বছরে প্রকল্প থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি মূল্যায়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুটো কারণে এ মূল্যায়ন করা উচিত। প্রথমত, এই দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে আসলেই চীনের প্রকল্পগুলি সহায়তা করছে কিনা। দ্বিতীয়ত, চীনের সহায়তা প্রকল্পগুলির অগ্রগতি সন্তোষজনক হয়েছে কিনা।

করোনার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছিল, ২০২১ সালে ৭.২% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ড করে বাংলাদেশ তা কাটিয়ে উঠেছে। এছাড়া ২০২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৩% এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৫% হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সঠিক পথেই আছে। বাংলাদেশে চীনের সহায়তা প্রকল্পগুলি ধীরে ধীরে কিন্তু স্থিরভাবে বাস্তবায়িত হয়। তাই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর এগুলোর তেমন প্রভাব নেই। 

চীন প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ, চীন, ভারত এবং মায়ানমার ইকোনমিক করিডরকে (বিসিএমআই) বিআরআইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের প্রতি একটু বেশিই আকৃষ্ট ছিল। কেননা বাংলাদেশের সাথে ভারত ও অন্যান্য দেশের প্রাণবন্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। 

বিসিআইএম করিডরেরর ক্ষেত্রে চীন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবের বৃহত্তর ক্ষেত্র ভারতের কথা মাথায় রেখে তা তারা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেনি এবং পরবর্তীকালে এটি একটি কৌশলগত চক্রান্ত হয়ে ওঠে। তবে চীন শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ ও মায়ানমারের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে তার সম্পৃক্ততা অব্যাহত রেখেছে কিন্তু তা বিসিআইএম করিডোরের বাইরে গিয়ে। 

বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য অবকাঠামো নির্মাণে চীনের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছিল। চায়নার বিনিয়োগের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একটা বিশাল সুযোগ ছিল। ২০১৫ সালে চীন বাংলাদেশকে তাদের বিআরআইতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের পরিবর্তে চীনের সঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণ বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে চুক্তির আট বছর পর কোভিড মহামারী, বেইজিংয়ের নিজস্ব পুনর্মূল্যায়ন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে যোগদানের জন্য বাংলাদেশকে মার্কিন সরকারের চাপ ইত্যাদির প্রভাবের কারণে এটির প্রাথমিক উদ্যম হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ এশিয়ার দ্রুততম উদীয়মান অর্থনীতির দেশ এবং ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। আট বছর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে যখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন তিনি ঢাকাকে ৪০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিআরআই এর প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন। যদিও বাংলাদেশের উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল তবুও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ এতে যোগ দেয়নি।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ আটটি প্রকল্পের জন্য চীনের সাথে ৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু (আনুমানিক খরচ ৩.৩বিলিয়ন ডলার), পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (১.৫৬  বিলিয়ন ডলার), জাতীয় আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক (১ বিলিয়ন ডলার) এবং পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প (১.৩২ বিলিয়ন)।

এরপর নেপাল চীনে তাদের বিনিয়োগের ব্যাপারে নজর দেয়। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে চীন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় দুটি ঋণ চুক্তিসহ নয়টি নতুন বিনিয়োগ চুক্তি উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে মোট ৭.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যা ২০১৫ সাল থেকে হিসেব করলে বাংলাদেশে চীনের মোট বিনিয়োগ হবে ১৬ বিলিয়ন ডলার। 

যদিও আপাতদৃষ্টিতে সব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে কিন্তু চীনের সহায়তা প্রকল্পগুলি নিয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষ রয়েছে। বিআরআইয়ের লক্ষ্য অর্জনে চীন যে অনুরোধ করছে তা রক্ষায় ঢাকা এখন আগ্রহী নয়। কেননা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী অন্যান্য দেশের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। এদিকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের তহবিল প্রদানের ধীরগতি নিয়ে ঢাকা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। 

এছাড়া  চীনের ঋণের ফাঁদ যা শ্রীলঙ্কা প্রত্যক্ষ করেছে এবং বর্তমানে পাকিস্তান যার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে তা এখন বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদেরও ভয় দেখাচ্ছে। গতবছর আগস্টে বাংলাদেশের মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিল, বিআরআই এর অধীনে চীনের থেকে ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার পুনর্বিবেচনা করবে। কেননা এমনকিছু ঋণ রয়েছে যা চীনের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি করে এবং ঋণগ্রহীতা দেশকে ঋণখেলাপি করে ফেলে। 

যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ও স্থিতিস্থাপক, তবুও সাম্প্রতিক সময়ে তা চাপের মধ্যে আছে। বিশেষ করে ঋণ খেলাপি, ব্যাংকিং খাতে পঙ্গুত্ব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ইত্যাদি কারণে বিদেশ থেকে অবকাঠামো নির্মাণের কাঁচামাল আমদানিতে সংকটে পড়ে বাংলাদেশ। তাই ২০২২ সালের জুলাইয়ে দেশটি ৪.৫ বিলিয়নের বেইল আউট প্যাকেজের অনুরোধ করেছিল। এই সংকটের কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প যেমন সড়ক উন্নয়ন এবং ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে।   

তবে এত সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে একটি প্যাকেজ পেতে সক্ষম হয়। ২০২৩ সালে জ্বালানি শক্তি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি মোকাবেলা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করে।

 বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করছে সেসব প্রকল্প চীনা কোম্পানি দ্বারা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে উদ্বেগের বিষয় হলো চীনা কোম্পানিগুলো এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামাজিক ও পরিবশগত প্রভাবের উপর দৃষ্টিপাত করে না। একারণে প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার তাদের মাইটসন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে সামাজিক ও পরিবেশগত অভিযোগ পাওয়ায় প্রকল্পটি বাতিল করে। 

তবে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। অতীতে চীন তার "স্ট্রিং অফ পার্লস স্ট্যাটেজি" বাস্তবায়নের জন্য  শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর ও পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের সাথে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে  সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছিল। তবে বাংলাদেশে বুদ্ধিমত্তার সাথে এ প্রস্তাব নাকচ করেছিল। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান যে ভুল করেছিল তা বাংলাদেশ করেনি। 

বর্তমানেও বাংলাদেশকে একই ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশ যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারতের এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে আগ্রহী। বাংলাদেশের এখন সকল সহযোগী দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার সময়।

আই.কে.জে/

বাংলাদেশ চীন

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন