ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ এমন একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বসবাস। এখানে প্রতিটি ধর্ম-বর্ণকে সমান সম্মান দেওয়া হয় এবং প্রতিটি ধর্মের উৎসব অত্যন্ত উৎসাহের সাথে পালিত হয়। জামাই ষষ্ঠী হলো এমনই একটি পারিবারিক উৎসব বা অনুষ্ঠান। জামাই ষষ্ঠী হলো একটি পরিবারের জামাইয়ের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে উদযাপিত একটি বাঙালি উৎসব।
জামাই এই দিনে শ্বশুর বাড়িতে দুর্দান্ত অপ্যায়ন পায়। শাশুড়ি জামাইয়ের জন্য বিভিন্ন খাবার রান্না করেন এবং ব্যাপক উদযাপনের আয়োজন করেন।
তাহলে চলুন আজকের এই প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে, এটি জৈষ্ঠ্য মাসের ষষ্ঠ দিনে পালিত হয় এবং ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে এটি মে বা জুন মাসে পালিত হয়।
যদি একটি বিড়াল আপনার সামনে দিয়ে যায়, আপনার পথ চলা এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। আপনি স্থির থাকেন যতক্ষণ না অন্য একজন আপনার সামনে দিয়ে যায়। শুধু পথচারী নয়, গাড়ি ও মোটরসাইকেলে যাতায়াতকারীরাও থেমে যায়। বেশিরভাগ মানুষ বিড়ালের পথ অতিক্রম করাকে একটি অশুভ লক্ষণ বলে মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে বিড়ালের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সক্রিয়, যা ভবিষ্যতে ঘটতে চলেছে এমন খারাপ ঘটনার ইঙ্গিত দেয়।
শুধু রাস্তা পার হওয়াই নয়, বিড়ালের কান্নাকেও অশুভ মনে করা হয়। তবে, বছরে এমন একটি দিন আছে যখন বিড়ালকে খারাপ লক্ষণ বা অশুভ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না, সেই দিনটি হল জামাই ষষ্ঠী। বাঙালির কাছে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উৎসবের দিনটি হলো জামাই ষষ্ঠী। বিড়াল হলো মা ষষ্ঠীর বাহন এবং এই কারণেই জামাই ষষ্ঠীর দিন বিড়ালকে খুঁজে প্রসাদ দেওয়া হয়। বিড়াল না পাওয়া গেলে দুধ দিয়ে তার আকৃতি তৈরি করে প্রসাদ হিসেবে নিবেদনের প্রথাও রয়েছে।
মা ষষ্ঠী সম্পর্কিত লোক কাহিনী
মা ষষ্ঠী সম্পর্কে একটি খুব জনপ্রিয় লোককাহিনী আছে। সচ্ছল পরিবারের সাত পুত্রবধূর মধ্যে কনিষ্ঠ পুত্রবধূ ছিলেন একজন ভোজন রসিক। সে গোপনে খাবার ও পানীয় চুরি করত এবং বাড়িতে থাকা বিড়ালের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিত। বেচারা বিড়ালটিকে এর ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছিল এবং প্রচুর মারধর করা হয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্রবধূর এই অপকর্মে বিড়ালটি খুবই দুঃখিত হয়ে পড়ে এবং সে ষষ্ঠী দেবীর কাছে অভিযোগ জানায় এবং কনিষ্ঠ পুত্রবধূর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প করে।
কয়েক মাস পর ছোট পুত্রবধূ সন্তান প্রসব করলে রাতে বিড়ালটি শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে যায়। যতবারই ছোট পুত্রবধূর সন্তান হতো, বিড়ালটি তার সন্তানদের চুরি করে দেবীকে দিয়ে দিত। বারবার এমন হওয়ার কারণে ছোট মেয়ের জামাই মন খারাপ করতে থাকে।
আশেপাশের লোকজন তাকে ডাইনি বলতে শুরু করে। তারপর কয়েক মাস পরে ছোট পুত্রবধূ একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় এবং তাকে রক্ষা করার জন্য সারা রাত জেগে বসে থাকে। গভীর রাতে তিনি দেখলেন বিড়ালটি তার বাচ্চা মেয়েকে নিতে এসেছে। মা তো মা। কিভাবে বিড়ালটি তার সন্তানকে কেড়ে নিতে পারে, সে বিড়ালের সঙ্গে যুদ্ধ করে। বিড়ালটি ছোট পুত্রবধূর ব্রেসলেটে আঘাত পেয়ে পালিয়ে যায়। বিড়ালের রক্তের চিহ্ন দেখে ছোট পুত্রবধূও তাকে অনুসরণ করে মা ষষ্ঠীর দ্বারস্থ হলেন। সেখানে তিনি তার সব সন্তানকে জীবিত ও খেলা করছে দেখতে পেলেন।
দেবীর কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলে দেবী তাকে তার অপকর্মের কথা মনে করিয়ে দেন এবং বিড়ালের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন। ছোট পুত্রবধূ বিড়ালের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনিও দেবীর পূজা করবেন। এই নিয়ে তিনি তার সমস্ত সন্তানদের নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন এবং মা ষষ্ঠীর পূজা করেন। সেই সঙ্গে শুরু হয় জামাইষষ্ঠীর প্রথা।
জামাই ষষ্ঠীর নিয়ম কি?
প্রথা অনুসারে, শাশুড়ি ভোরে স্নান করে ষষ্ঠী দেবীর পূজা করেন। ষষ্ঠী দেবীর জল, দূর্বা, পান, পূজার সুপারি, মিষ্টি দই, ফুল ও ফল থালায় রাখা হয়। ষষ্ঠী দেবীর পুজোর জল জামাইয়ের গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তার আরতি করা হয়। তারপর জামাইকে দই তিলক লাগিয়ে ষষ্ঠী দেবীর হলুদ সুতো বেঁধে সর্বপ্রকার সুরক্ষা ও দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়।
কন্যা এবং জামাইয়ের সাথে শুভ কামনা করার সময়, ঈশ্বরের কাছে পুরো পরিবারের সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। নতুন পোশাক দেওয়া হয় এবং বিশেষ খাবার তৈরি করা হয়। বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী বিশেষ করে জামাইকে মিষ্টি, আম-লিচুসহ মৌসুমি ফল খাওয়ানো হয়। এরপরে খাবার খাওয়ানো হয়। এই সময়ে জামাইকে হাত পাখা দিয়ে পাখা দেওয়ার প্রথাও রয়েছে। এর পর জামাই ও মেয়েকে উপহার দেওয়া হয়।
জামাই ষষ্ঠী অরণ্য ষষ্ঠী পূজার পদ্ধতি
জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে এই ব্রত পালন করা। হয় এই ব্রতকে জামাইষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠী বা বাতা ষষ্ঠীও বলা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে এই ব্রত পালন করা হয়। সোম, মঙ্গল, শুক্র বা শনিবারে ষষ্ঠী পূজা পড়লেও পুজো করতে নেই। পুজো না থাকলে বাটা বা অন্যান্য দ্রব্য দেওয়া প্রয়োজন নেই। কেবল ব্রত কথা শুনলেই হবে এই ষষ্ঠীকে জামাইষষ্ঠীও বলা হয়। এই ব্রত বিশেষত সাধ্বারা এবং পোয়াতিরা করে থাকেন। এই ব্রত করতে করতে ছেড়ে দিতে নেই।
ব্রত পালনের নিয়ম
যে স্থানে পুজো করা হবে সেই স্থানটা ভালো করে পরিষ্কার করে সেখানে আলপনা দিতে হবে। এরপর বটের ডাল পাতা সমেত একটু মাটি দিয়ে বসিয়ে দিতে হবে। এবার এর সামনে জলপূর্ণ ঘট বসাতে হবে। এই ঘটের মুখে দই দিয়ে একটা কাঁঠালি কলা দিতে হবে। ঘরে সিঁদুর দিয়ে মা ষষ্ঠীকে অঙ্কন করতে হবে।
গঠন করে কাঁঠাল পাতায় রাখতে হবে। এবং পিটুলি দিয়ে কালো বিড়াল অঙ্কন করতে হবে। একটি নতুন জোগাড়িতে নানা রকমের ফল গোটা গোটা দিবেন একটা সাদা কাপড় হলুদ দিয়ে ছাপিয়ে ছটি বাঁশ পাতায় জড়াবেন। সাদা সুতোয় হলুদ বাটা মাখিয়ে তাতে জড়াতে হবে এবং সিঁদুরের ফোটা দিয়ে ঘরের কাছে রাখতে হবে একটি থালায়। ছটি ক্ষীরের নাড়ু, ছটি বাতাসা দিবেন আর একটি থালায় নারিকেল নাড়ু আম ছোলা মটর সন্দেশ এবং আতপ চাল দিয়ে নৈবেদ্য সাজাবেন। এইভাবে প্রতি পোয়াতিকে এক এক দফা দিতে হবে। পুজোর শেষে মা ষষ্ঠীর ধ্যান করতে হবে।
মনে মনে মা ষষ্ঠীর ধ্যান করার পর এই ব্রতকথা শুনতে হবে এবং পরিশেষে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করতে হবে। পুজোর পর ছেলেমেয়েদের কপালে হলুদ ছুঁয়ে এই হলুদ শুধু তাদের ডান হাতে বেঁধে দেবেন। এই হলো ষষ্ঠী পূজা বা অরণ্য ষষ্ঠী বা বাতা ষষ্ঠীর নিয়ম বা পদ্ধতি।
জামাই ষষ্ঠী কেন পালন করা হয়
কিংবদন্তি অনুসারে, বৈদিক সমাজ থেকেই জামাইষষ্ঠী পালন হয়ে আসছে। জৈষ্ঠ মাসের শুক্রা ষষ্ঠী তিথিতে প্রথম প্রহরে ষষ্ঠী দেবীর পূজোর আয়োজন করা হয়। ষষ্ঠী দেবীর বাহন হলো বিড়াল। ষষ্ঠীদেবী হলেন মাতৃত্বের প্রতীক। পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি ও সন্তানের কল্যাণের জন্য এই পুজোর উদ্দেশ্য।
বাঙালি সমাজে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, যে পরিবারের সদ্য বিবাহিত কন্যা রয়েছে সেই পরিবার এই পর্বটি খুব ঘটা করে পালন করে ষষ্ঠী দেবীকে জৈষ্ঠ্য মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্তুষ্ট করতে হয়। যার ফলে বিবাহিত কন্যাকে সন্তানবতী হওয়ার আশীর্বাদ দেন।
এখন মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাই যোগ করে হয়েছে জামাইষষ্ঠী। প্রকৃতপক্ষে জামাইষষ্ঠীর আসল উদ্দেশ্য হলো মেয়ের যাতে দাম্পত্য জীবন সুখসমৃদ্ধিতে ভরপুর হয়। তার জন্য মঙ্গল কামনা করা। এটা গেল প্রচলিত কথা।
জামাইষষ্ঠী পালনের পেছনে ঐতিহাসিক বিভিন্ন কথাও রয়েছে। বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথার সঙ্গেও জড়িত আছে জামাইষষ্ঠী পালনের অন্যতম কারণ। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে জামাইষষ্ঠী উৎসব প্রাধান্য পেতে থাকে বহু লোকের ঘরে ঘরে। পন্ডিতদের মতে এর কারণ একটি তৎকালীন প্রচলিত বাল্যবিবাহ সতীদাহ প্রথার যুগে জামাইয়ের দীর্ঘ জীবন কামনা করা হতো। যাতে মেয়েকে বাল্য বৈধব্য বা আগুনে পুড়ে মরতে না হয়।
আরো পড়ুন: নমস্কার কী এবং কেন করা হয়
জামাইষষ্ঠী পালনের আরও একটি কারণ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সংস্কার ছিল কন্যা সন্তান লাভ পর্যন্ত মা বাবা মেয়ের মুখ দেখবে না। বা মেয়ের বাড়িতে যাবে না। সন্তান লাভের বিভিন্ন সমস্যার জন্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। এর সমাধান করতে জৈষ্ঠ মাসের শুক্লা ষষ্ঠী কে জামাইষষ্ঠী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এই সুযোগে কন্যার মুখদর্শন করা হতো। এবং মা ষষ্ঠীকেও সন্তুষ্ট করা হতো। যাতে কন্যা সন্তান লাভ করার আশীর্বাদ পায়। এইভাবে মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইষষ্ঠী যুক্ত হয়ে এখন জামাইষষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে।
কিভাবে পালন করা হয় জামাইষষ্ঠী
ষষ্ঠী পূজার উপকরণ: আম্রপল্লব (আমপাতা), দুর্বা, তালপাতার পাখা, ধান, ৫ থেকে ৯ রকমের ফল-ফুল এবং বেল পাতা, সাদা সুতো এবং হলুদ সুতো।
শাশুড়িরা কিভাবে মা ষষ্ঠীর আরাধনা করেন: ষষ্ঠী পূজার উপলক্ষে শাশুড়িরা ভোরবেলা উঠে স্নান করে ঘটে জল ভরে নেন। ঘটের ওপর স্থাপন করেন আম্রপল্লব। সঙ্গে তালপাতার পাখা ১০৮ টি দুর্বার আটি দিয়ে পুজোর উপকরণ সাজানো হয়।
কাঁঠাল পাতার উপর পাঁচ থেকে নয় রকমের ফল কেটে সাজিয়ে রাখতে হয়। সাদা সুতো হলুদের রাঙিয়ে ফুল বেল পাতা দিয়ে গিট বেঁধে সাজানো হয়। এরপর মা ষষ্ঠীর পুজো করা হয়। জামাই এলে সুতোটি জামাইয়ের হাতে বেঁধে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করে ধান দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। সবাই এই নিয়মগুলি পালন না করলেও জামাইকে সদর নিমন্ত্রণ করে আদরে খাওয়ান সবাই।
জামাইষষ্ঠীর বিভিন্ন নিয়মগুলির মানে কী?
সুতো-ফুল-বেলপাতা বেঁধে দেওয়ার অর্থ হল জামাই এর সঙ্গে পরিবারের বন্ধন অটুট থাকুক এবং মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে বন্ধন সুখবর হোক এবং সারা জীবন দাম্পত্য জীবন অটুট থাকুক।
পাখা দিয়ে হাওয়া করার অর্থ হল জামাইয়ের আপদ বিপদ দূরে থাক এবং শান্ত থাকুক পরিবেশ।
তিনবার ষাট ষাট বলার কারণ দীর্ঘায়ু কামনা করা।
ধান সমৃদ্ধি ও সন্তানের প্রতি দুর্বা চির সবুজ ও চির সতেজের প্রতীক।
এইসব জামাই ও মেয়ের মঙ্গল কামনা এবং সুখ শান্তিতে থাকা ও দাম্পত্য জীবন ভালো থাকার প্রার্থনা করার জন্য।
এসি/আই. কে. জে/
খবরটি শেয়ার করুন