ছবি: সংগৃহীত
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার নামে একটি নগ্ন 'ভিডিও' ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন মাধ্যমে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও 'ভিডিওটি' এবং এর থেকে নেওয়া 'ছবি' গতকাল বুধবার (৬ই আগস্ট) রাত থেকে 'ভাইরাল' (আলোচিত)। ভিডিও, ছবিতে বয়স্ক এক পুরুষকে একদম নগ্ন দেখা যায়। তার শরীরের 'প্রাইভেট পার্টে'ও কোনো কাপড় নেই। ভিডিওতে একপর্যায়ে বৃদ্ধ লোকটিকে নিজের গোপনাঙ্গের দিকে তাকিয়ে বিশেষ অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা যায়। সুখবর ডটকমের কাছে কথিত যে ভিডিওটি এসেছে, তা এক মিনিটেরও চেয়ে কম সময়ের।
'ভাইরাল' হওয়া পুরো ভিডিওটি অস্পষ্ট। সুখবরের অনুসন্ধান বলছে, প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী জেড আই খান পান্নার নামে ওই নগ্ন 'ভিডিও' মূলত ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণপন্থী কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে। এসব অ্যাকাউন্ট কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির বদলে নানা নামে পরিচালিত হচ্ছে। অ্যাকাউন্টগুলো থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময় আপত্তিকর পোস্ট দেওয়া হয়েছে। যা দেশের ধর্মপন্থী একাধিক রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। তবে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেকে ধরে নিয়েছেন, কথিত ওই ভিডিও জেড আই খান পান্নারই বিশেষ মুহূর্তের। ভিডিওটির বিভিন্ন লিংকে তাদের মন্তব্য ও সেটি শেয়ার করা থেকে তা অনুমান করা যাচ্ছে।
আবার অনেকে বলছেন, এআই সফটওয়্যার বা অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন মানুষের ছবি এডিট করে সেখানে অশ্লীল, নগ্ন ছবি বা ভিডিও বানিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজে। যার ভুক্তভোগী ইতিমধ্যে দেশের অনেকেই হয়েছেন। সবশেষ এই তালিকায় যুক্ত হলেন জেড আই খান পান্না। তার নামে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি ভুয়া এবং তা এআই দিয়ে বানানো। তারা অভিযোগ করেন, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় জেড আই খান পান্না সাহসী ভূমিকা পালন করছেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, নতুন প্রজন্ম ও ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘মঞ্চ ৭১’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছেন। এ কারণে একটি শ্রেণি রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকে তার নামে কথিত ভিডিওটি বানিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, 'আমরা শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত যে স্তরেরই হই, একটা ফেক ভিডিওকে আমরা তখনই লুফে নিচ্ছি, যখন সেটা আমার কিংবা আমার দলের মতাদর্শের সঙ্গে যাচ্ছে আর বিরোধীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আবার ভুল হলে নামিয়ে ফেলছি, কিন্তু এর মধ্যেই একটা ডিজাস্টার (ক্ষতি) হয়ে গেল।'
কথিত ওই ভিডিও সম্পর্কে বীর মুক্তিযোদ্ধা জেড আই খান পান্না সুখবরকে বলেন, 'আজ (বৃহস্পতিবার, ৭ই আগস্ট) নিজের একটি উলঙ্গ ও বিকৃত ছবি দেখে চমকে উঠেছি। এটাও সম্ভব? একই ধরনের ছবি কিছুদিন আগে জনৈক ব্যাংক কর্মকর্তার নামে প্রকাশ করার পর তিনি জানিয়েছিলেন যে, সেগুলো এআই পদ্ধতিতে বানিয়ে পোস্ট করা হয়েছে। আজ নিজের ছবি দেখে আমি একটা বিষয় লক্ষ করলাম, ওই ব্যাংক কর্মকর্তার ছবির সঙ্গে শতভাগ মিল রেখে আমার নামে একই কাজ (ভিডিও) করা হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমি এই অবস্থার সন্মুখীন হয়েছি, এর মূল কারণ হলো, ৭১ মঞ্চ সৃষ্টি করা। যারা মনে করেন যে, এই ধরনের ছবি বা অডিও প্রকাশ করার মাধ্যমে আমার দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকাণ্ড থামিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, তারা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। আমার সারা জীবনের অর্জন তাদের মতো কিছু রাজাকার ও রাজাকারের বংশধরদের অসৎ কাজ দিয়ে বিনষ্ট করা যাবে না।'
গুগলের ভিউ টুলস দিয়ে বানানো ৭০টি ভুয়া ভিডিও সম্প্রতি বিশ্লেষণ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, দেখতে ও শুনতে অনেকটাই বাস্তবের মতো হওয়ায় অনেকের জন্যেই এই ধরনের ভিডিওগুলো আসল কী না, তা শনাক্ত করা কঠিন। আর সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন অনেকে, যাদের মধ্যে আছে রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের কর্মীরা। গুগল টুলস লিখে কিংবা বলে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী এ ধরনের ভিডিও তৈরি করতে পারে দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে। এতে খরচও হয় খুবই সামান্য।
মাত্র হাজার দুয়েক টাকায় কেনা যায় হাজার ক্রেডিট, যা দিয়ে বানানো যায় প্রায় ৫০টি ভিডিও। কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে বিনামূল্যেই এসব টুলসে এক্সেস করা যায়। ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা ভিডিওগুলো দেখা হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখের বেশি বার, আর সেগুলোতে রিঅ্যাকশন পড়েছে ১০ লাখের বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি অন্যদের মানহানিও থাকে এ ধরনের ভিডিওর টার্গেট।
অনুসন্ধানে ও বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই দিয়ে তৈরি নানাজনের নগ্ন ছবি, ডিপফেক ভিডিও। প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, মানুষকে ধোঁকা দেওয়া বা বোকা বানানো তত সহজ হয়েছে। যে কোনো সংকটে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরও বেশি করে ছড়ায় এ ধরনের ছবি। এআই ফটোগ্রাফারদের কখনো উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, কখনোবা নিছক গুজব ছড়িয়ে মজা নেওয়া। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগতভাবে দেশের প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত যৌন মুহূর্ত ও নগ্ন ছবি এভাবেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোসফটস এআই ইমেজ জেনারেটর, মিডজার্নি, ডাল ই, ডিপএআই—এ রকম বিভিন্ন ইঞ্জিন ব্যবহারের মাধ্যেম ছবি তৈরি করে এআই। সাধারণত পাবলিক ডোমেইনে থাকা অন্য ছবি থেকে তথ্য নিয়ে ছবি বানায়। ফলে এআইয়ের বানানো ছবিতে কিছু অসঙ্গতি থেকে যায়। ব্যক্তির ছবিতে, বিশেষ করে হাত, পা ও আঙুলে অসামঞ্জস্য দেখা যায়। হাত ও পায়ের আঙুল দেখতে অস্বাভাবিক লাগে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে হাত ও পায়ের আকৃতি অন্য রকম দেখায়। অনেক সময় হাত ও পায়ের অবস্থান, দিক ঠিক থাকে না। জেড আই খান পান্নার ছড়িয়ে পড়া ছবিতে এমন অসংগতি লক্ষ্য করা গেছে।
এআইয়ের বানানো ভিডিও ও ছবিতে মানুষের চেহারা সাধারণত বেশি ‘গ্লো’ করে। ‘শার্পনেস’ থাকে না। এআই দিয়ে বানানো মানুষের চেহারার ভেতরে একটু কার্টুন-কার্টুন ভাব থাকতে পারে। মানুষের চোখের মণির খুঁটিনাটি সাধারণত পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললে ওই ছবি তোলার কিছু তথ্য পাওয়া যায়, যেমন কোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা, কবে, কখন তোলা, কে তুলেছে, ছবি তোলার সময়কার বর্ণনা ইত্যাদি। এআই দিয়ে বানানো ছবিতে স্বাভাবিকভাবেই তা থাকবে না। জেড আই খানের ভিডিও ও ছবিতে তেমনি দেখতে পাচ্ছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ও ভাইরাল হওয়া কোনো ছবি ও ভিডিওর সূত্র যাচাই করতে কেউ গুগল লেন্স ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহার করতে পারেন ‘রিভার্স ইমেজ সার্চ’। হাইভ মডারেশন ও ইয়ানডেক্সের মতো টুলও ব্যবহার করতে পারেন। ফেক ছবি যত বেশি ছড়ানো শুরু হয়েছে, এ ধরনের অ্যাপগুলোও জনপ্রিয়তা পেয়েছে সমান তালে। এসব ব্যবহার করে ছবিটি আর কোথায় কোথায় ব্যবহৃত হয়েছে খুঁজে পাওয়া যায়। এআই দিয়ে তৈরি ছবি ও ভিডিও খুব অল্প কিছু জায়গায় খুঁজে পাওয়া যাবে। বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট বা সূত্র থেকে ছবিটি এসেছে কী না, সেটিও বোঝা যাবে। জেড আই খান পান্নার ভিডিও ও ছবিগুলোর বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট বা সূত্র পাওয়া যায়নি।
দেশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এআই সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের উচিত কিছু নীতি তৈরি করা, যাতে করে সাধারণ মানুষ এর অপব্যবহার করতে না পারে। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের সরকারের আইটি ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, পুলিশ প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি আইন চালু করা উচিত। যাতে করে ভুক্তভোগীদের করা অভিযোগে অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা যায়।
খবরটি শেয়ার করুন