বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, নির্বাচনের বিলম্ব, সংবিধান সংশোধন, জাতিগত ও ধর্মীয় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি, পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা—এসব বিষয় নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন দ্য নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর।
গতকাল মঙ্গলবার (১২ই আগস্ট) চ্যানেল আই-এর জনপ্রিয় টকশো ‘তৃতীয় মাত্রা’তে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নূরুল কবীর। বক্তব্যে তিনি বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, সংখ্যালঘু ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি, এবং সংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তায়, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
আজ বুধবার (১৩ই আগস্ট) দুপুর সোয়া ২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত টেলিভিশনটির নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিওটি ২৬ হাজার ৮৪০ বার দেখা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক ন্যায্যতা
নূরুল কবীর বলেন, ‘এই সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার পেছনে যে রাজনৈতিক প্রভাব ও শক্তি কাজ করেছিল তা ছিল জটিল এবং বহুস্তরীয়। মূলত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি এবং জনগণের উচ্চমাত্রার প্রত্যাশা দ্বারা এটি সংঘটিত হয়েছিল। যারা জাতীয় নাগরিক পার্টি হিসেবে সংঘটিত হয়েছিলেন, তারা গণঅভ্যুত্থানের সময় সামনের সারিতে ছিলেন। তখনকার প্রেক্ষাপটে, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থনগুলো গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে বর্তমান সরকারের প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন।'
তিনি বলেন, 'পরবর্তীকালে, অন্যান্যদেরও তার ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই ঘটনায় সেনা নেতৃত্বও ফ্যাসিলিটেশন প্রদান করেছিল। ফলে সরকারের রাজনৈতিক ন্যায্যতার পেছনে এই সব ফ্যাক্টর কাজ করেছে, এবং জনগণের কোনো অংশ বা গোষ্ঠী বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রদায় এর বিরোধিতা করেনি। এর ফলে সরকারের একটি সার্বজনীন রাজনৈতিক ন্যায্যতা তৈরি হয়েছিল, যা তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।’
সরকারের মূল কাজের লক্ষ্য
নূরুল কবীর উল্লেখ করেন,
- গণতান্ত্রিক গভর্নেন্স নিশ্চিত করা।
- গণঅভ্যুত্থানের সময় আহত ও নিহতদের জন্য অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা।
- নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা যথার্থভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা।
তিনি আরও বলেন, জনগণের ১৫ বছরব্যাপী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বিজয়ের আবেগ এত প্রবল ছিল যে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের মেয়াদ নিয়ে চিন্তিত ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি শুরু হয় এবং ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের দাবি উঠে আসে।
নির্বাচন বিলম্ব ও গভর্নেন্সের বাস্তবতা
নূরুল কবীর বলেন, ‘ভ্রান্ত ধারণা ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি নির্বাচন বিলম্ব করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারের ভেতর যারা বিরোধিতা করতেন, তারা বুঝতে পেরেছেন এই বিলম্ব আর সম্ভব নয়। যদিও গভর্নেন্সের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ কম দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং চাঁদাবাজি বেড়েছে। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’
দুর্নীতি ও উপদেষ্টাদের ভূমিকা
সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন। এ বিষয়ে নূরুল কবীর বলেন, ‘অবিচ্ছিন্ন প্রমাণ ছাড়া কোনও নাম উচ্চারণ করা ঠিক নয়। কিছু উপদেষ্টার ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং স্বীকারোক্তি বা মাঝারি অবস্থান রয়েছে। তবে সরকারের কোন গুণগত উত্তরণ ঘটেনি। নির্বাচনের সময়সীমা প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগ্রহ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘জায়ামাত ও এনসিপি এই পরিস্থিতিতে আরও সময় পেলে নিজেদের সুবিধা দেখতে পারত। তবে ড. ইউনূসের দৃঢ়তা থাকলে নির্বাচনের বিলম্ব কার্যকর হবে না। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি প্রয়োজন, যেমন পুলিশের ও সশস্ত্র বাহিনীর আস্থা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সমঝোতা। কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রস্তুতিও জরুরি।’
সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কার
নূরুল কবীর সংস্কারের প্রসঙ্গে বলেন, ‘কিছু সেকেন্ডারি সংস্কার প্রস্তাবনা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণ করা হয়েছে। তবে পার্লামেন্টের প্র্যাকটিসে আরও উন্নতি প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এমপিদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটা এটি বাস্তবায়ন করবে, তা বিবেচনা করতে হবে। সংস্কার কেবল আইনি নয়, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া কার্যকর হবে না।’
তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশে এত মৃত্যুর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়নের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, কিন্তু তা যথাযথভাবে চর্চিত হয়নি। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর দেওয়া বাণীও বিতর্কিত। সংবিধানে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, কিন্তু প্রেসিডেন্টের বিবেক ও বাক স্বাধীনতার যথাযথ নিশ্চয়তা নেই। এটি সংশোধন অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রের ন্যায্যতা এবং জনগণের আস্থা রক্ষায় এটি অপরিহার্য।’
জাতিগত স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি
নূরুল কবীর বলেন, ‘জাতিগত স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ও অংশগ্রহণ করেছে। তবে তাদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি এখনো নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্রের মধ্যে জাতিগত বিভাজন রাজনৈতিক সুস্থতা নষ্ট করেছে। সমান অধিকার শুধু মৌখিকভাবে নয়, কার্যকর নীতি ও আইনগতভাবে নিশ্চিত করা জরুরি। এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তির জন্য অপরিহার্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানে বলা হয়েছে কোনও ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হবে না। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা হয়েছে, যা সুবিধাবাদী রাজনীতির ফল। এটি অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ। স্বাধীনতার পর এই দুটি গণতান্ত্রিক সংস্কারের সুযোগ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তা যথাযথভাবে চর্চিত হয়নি। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের মৌলিক দায়িত্ব।’
ভবিষ্যতের নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
নূরুল কবীর বলেন, ‘বর্তমানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বিএনপির ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এখনও রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে তাদের অবস্থান সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করছে না। বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন আহমদ এবং তার দলের নেতারা বলছেন যে, সব নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। তবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ‘সহ-উপজাতি’ বা নতুন শব্দ দিয়ে, যা বিভাজনের চিহ্ন বহন করছে। এটি রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ মর্যাদা প্রয়োজন নয়; প্রয়োজন যারা সংখ্যানুপাতিকভাবে কম। তবে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা ছাড়া জাতিগত বিভাজন ও রাজনৈতিক সংঘাত চিরস্থায়ী হবে। অতীত আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সুযোগগুলো নষ্ট হচ্ছে।’
নাগরিক অধিকার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির গুরুত্ব
নূরুল কবীর বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার ও সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক অধিকার সমান হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য বিদ্যমান। এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া সংবিধানিক অধিকার কার্যকর হয় না।’
তিনি মনে করেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার শুধু আইনগতভাবে নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক চর্চার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি প্রতিষ্ঠা না হলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী, ধারাবাহিক এবং সব স্তরে সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল।’
খবরটি শেয়ার করুন