হামিম কামাল
১৯৪১-এর ৫ ও ৬ এপ্রিল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ উৎসবে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর শেষ ভাষণটি দিয়েছিলেন– যদি আর বাঁশি না বাজে। সেই ভাষণের কিছু বাক্য বাঙালি কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
“আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন আমি। এই হোক, আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায় না দান, কবি চায় অঞ্জলী। কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতের বীণা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে, তাকে ক্ষুধা-দীর্ণ মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি…”
জগতে সুখ আর দুঃখের মাঝে ভারসাম্য রক্ষিত হয়– এ কথা শুনতে সত্য শোনালেও বাস্তবে কতখানি, তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। পদার্থবিজ্ঞান বলছে, যতক্ষণ বিভবে পার্থক্য থাকে, ততক্ষণ থাকে তড়িৎপ্রবাহ। জীবনপ্রবাহ বজায় রাখার স্বার্থেও ঘটছে ঠিক তা-ই। নয়ত কেন আমাদের সংগ্রাম এক মুহূর্তের জন্যেও থেমে নেই, কেন একটি লক্ষ্য অর্জিত হলে তা আরও দশটি ক্ষত রেখে যাচ্ছে? যে মুহূর্তে বাঙালি চিন্তা, বীক্ষা ও চেতনায় একটি স্তরে এসে পৌঁছেছে, সেই মুহূর্তে কবি নজরুল বিষণ্নতম “যদি আর বাঁশি না বাজে” শুনিয়েছিলেন।
বিদ্রোহী কবিতায় আছে– “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন।” ভৃগু যেমন ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন, নজরুলও তেমনই ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন। ১৯৪১ সালে ভাষণ দানের পরের বছরে নজরুল দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এবং ক্রমশ তাঁর সৃষ্টির অবাধ ধারাটি যেন মৃত্যুচিহ্নিত হয়ে যায়। একসময় থমকে যায়। এবং ১৯৪১-এ নজরুলের সেই ভাষণের মাত্র দুই মাস পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর বুকে শেষ শ্বাসটি গ্রহণ করেন। রবি নেই, নজরুলও ‘নেই’; রাজনৈতিক সংক্ষুব্ধতায় বাহ্যিক অতো রক্তক্ষরণের পরও বাঙালি ও বাংলা ভাষা যেন একটা স্বপ্নময় সময় অতিক্রম করছিল; তার অবসান হলো। এবং যে ভারসাম্যহীনতাটি তাতে তৈরি হয়েছিল, মানুষ হিসেবে আমরা চণ্ডাল সংগ্রামী হওয়া সত্ত্বেও তার ধকল সামলাতে পারিনি। এক ঘোরগ্রস্ত সময়ে ঘটে গিয়েছিল ততোধিক ভ্রমগ্রস্ত দেশভাগ।
মানুষ তো অগ্নিশিখাতুল্য। একটি শিখা অপরকে জ্বালায়। নজরুলকে কে জ্বালিয়েছেন? নায়ক তার যাত্রাপথে অগণিত গুরুর দেখা পান। নজরুলও পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথসহ আরও অনেককে। তবে প্রথম বাতিটি জ্বেলেছেন বোধকরি নিবারণচন্দ্র ঘটক। সেই যে রাণীগঞ্জ সিয়ানসোল রাজ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, গোপন বিপ্লবী! ১৯১৪ সালের কথা। নজরুলের উন্মাদ জীবনের শুরুটা ঘটে গেছে। তবে সেই উন্মাদনাকে পথ কেটে মানবমুক্তির সিংহদ্বারে নিয়ে চলার প্রাকৃতিক আয়োজনটা তখনও শুরু হতে বাকি ছিল। নিবারণচন্দ্রের আবির্ভাবে তা ঘটল। ক্রমশ তা কোথায় উন্নীত হলো, তা জাতি জানে। বিশ্বও।
“হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা। - দিয়াছ তাপস,
অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার
বাণী মোর শাপে তব হলো তরবার!”
কবি নজরুল। জাতির দারিদ্র্যে বৈভবের বিপুলতা নিয়ে, বৈষম্যের বলিপ্রহরে যূপকাষ্ঠের কাছে ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়ে, শক্তিমতি শব্দরূপ ব্রহ্মাস্ত্র উচ্চারণে মানুষটি ছিল নক্ষত্রের মতো বিকিরিত। এই বিকিরণ তাঁকে চিরসমকালীনতা দিয়েছে। সময়ের সীমা ছাপিয়ে আমাদের এই অবধি তাঁর বাণীকে নিয়ে এসেছে, ভবিষ্যতেও তা বাহিত হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তারাক্ষ্যাপাটিকে ভীষণ ভালোবাসতেন। একটি গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছিলেন, নাম “বসন্ত”। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল : শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম / স্নেহভাজনেষু [১০ ফাল্গুন, ১৩২৯]। নজরুল তো তখন “হৈ হৈ কাজী”; আনন্দ আর উৎসাহের সহস্রধারা। বসন্ত গীতিনাটকের ভাষ্য রাজনৈতিক আর ভাষাটি ছিল কৌতুকময়; বুঝি রবীন্দ্রনাথ স্বভাবসুলভ আমুদে বচনপ্রতিভা একদম খোলামনে দান করেছেন। উৎসর্গ করার মতো কবি নজরুল ছাড়া উপযুক্ত আর কেউ ছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহ করা চলে। যাহোক, সেই নাটকের প্রথম দৃশ্যের কিছু অংশ উল্লেখ করছি। রাজকোষের অবস্থা খারাপ। সভা থেকে রাজা তাই পালিয়ে এসেছেন রাজকবির কাছে। “কবি!” / “কী মহারাজ?” / “আমি মন্ত্রীসভা থেকে পালিয়ে এসেছি।” কবি বললেন, “… এ দলে আপনি রাজসঙ্গীও পাবেন।” রাজা বললেন, “রাজসঙ্গী? কে বলো তো?” / “ঋতুরাজ।” / “ঋতুরাজ? বসন্ত?” কবি বললেন, “হাঁ মহারাজ, তিনি চিরপলাতক …”
রাজা বললেন, “বুঝেছি, বোধ করি রাজকোষের অবস্থা দেখে পালাতে ইচ্ছে করেছেন।” কবি বললেন, “পৃথিবীর রাজকোষ পূর্ণ করে দিয়ে তিনি পালান।” রাজা বললেন, “কী দুঃখে!” কবি বললেন, “দুঃখে নয়, আনন্দে!”
রবীন্দ্রনাথ জানতেন, নজরুল সেই ঋতুরাজ। পৃথিবীর রাজকোষ পূর্ণ দিয়ে ক্ষ্যাপা উন্মাদ হাসি হেসে পালায়। তবে প্রকৃতির প্রয়োজনে তাঁর আবির্ভাব ঘটে বারংবার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করে, যখনই জাতির ক্রান্তিলগ্ন, শৈত্য, উপস্থিত, ত্রাতা হয়ে এই ঋতুরাজ বাণীরূপে ঠিক উপস্থিত হয়েছেন। ভবিষ্যতেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না। আজ ১২ ভাদ্র, ১৪৩০ নজরুলের ৪৮তম প্রয়াণ দিবসে সেই এই অনিবার্যতার কথাই মনে জাগছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আমাদের অন্তরের অন্তস্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আই. কে. জে/