ছবি: সংগৃহীত
গুটি গুটি পায়ে আসছে শীত, আর তার সাথে শুরু হবে বিয়ের মৌসুম। অসংখ্য ট্রেন্ডের ভিড়ে বিয়েতে বেনারসি শাড়ির আবেদন আজও কমেনি, মিশে আছে বাঙালির ফ্যাশন আবহে। তাই শাড়ির দোকানে হবু কনেদের বেনারসি কেনার ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। আপনারও কি সামনেই বিয়ে? বেনারসি কেনার পরিকল্পনা করছেন? তাহলে চলুন জেনে নিই বেনারসি সম্পর্কে জানা-অজানা সব কথা-
বেনারস থেকে বাংলা
মোগল সাম্রাজ্য থেকে শুরু হয় বেনারসি শাড়ির যাত্রা। এরপর ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁতিরা ছড়িয়ে পড়েন। বেনারসি তাঁতিদের একটি বড় অংশ ছিল মুসলমান। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে প্রথম সমস্যার সম্মুখীন হয় এ শিল্প। ইংরেজ শাসনামলে মুসলিম তাঁতিদের কিছু অংশ পূর্ব-পাকিস্তানে নিবাস গড়ে তোলেন। আর কিছু চলে যান পশ্চিম-পাকিস্তানে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের নারিন্দা, ইসলামপুর, নবাবগঞ্জ, সিদ্দিক বাজার, বেচারাম দেউড়ি, দক্ষিণ মৈশুন্ডি ও নবাবপুরে বেনারসি বয়নে পটু তাঁতিরা হস্ততাঁত স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে এই স্থানগুলোতে জনসমাগম ঘটে। তাঁতশিল্পীদের কাজের জন্য শব্দহীন পরিবেশের উপযোগিতা আছে। মুখরতা তাদের শিল্পমন প্রকাশের অন্তরায়। তাই স্থান পরিবর্তনের পরিকল্পনা আঁটেন তারা। নতুন আবাসস্থলের খোঁজে একসময় বর্তমানের মিরপুর ১০ এবং মিরপুর ১-এ এসে থিতু হন। তারই পরিক্রমায় আশপাশের জায়গাতেও তাঁতিরা আবাস গড়তে শুরু করেন। মিরপুরের সেকশন ১০, ১১ ও ১২ জুড়ে গড়ে ওঠে বেনারসি পল্লি।
বয়ন-বুনন
বেনারসে বেনারসি শাড়ির দুটি বয়ন কৌশল রয়েছে—কাধুয়া এবং ফেকুয়ান। কাধুয়ান একটি বিশুদ্ধ তাঁত যা শুধু বারাণসী অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। এই জটিল ডিজাইনগুলো শুধু হাতে চালিত তাঁতেই তৈরি হয়। এজন্য এই শাড়ি তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ। এক-একটি কদুয়ান বেনারসি শাড়ি বুনতে তিনজন তাঁতির সময় লাগে ৩-৪ মাস। বেনারসি শাড়ির জন্য চারটি প্রধান কাপড় ব্যবহার করা হয়, খাঁটি সিল্ক (কাতান সিল্ক), অরগ্যানজা, জর্জেট ও শাত্তির। এর মধ্যে বিশুদ্ধ সিল্কের বেনারসি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম দিকে মিরপুরের নিজস্বতা ছিল সুতি বেনারসি বুননে। আর বেনারসি কাতান তখন তৈরি হতো পাকিস্তানে। মিরপুর বেনারসি পল্লিতে শাড়ি বুনন করা হয় হস্ততাঁতের মাধ্যমে। এভাবে একটি শাড়ি তৈরিতে প্রয়োজন অন্তত দুই মাস। কখনো কখনো নকশার ভিন্নতার কারণে প্রয়োজন হয় ছয় মাসের।
আরো পড়ুন : শাড়ির সাথে যে তিন শীত পোশাক মানানসই
শাড়ির নকশা
বেনারসি শাড়ির মূল ডিজাইনের ধারা সৃষ্টি হয়েছে মোগল ঘরানা থেকে। ফুল ও আল্পনার মোটিফ, কালগা ও বেলপাতার নকশা। সেসব নকশায় শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে বা রূপালি সোনালি সুতার জমাট কাজ। প্রতিটা শাড়ি বুনতে সময় লাগে ৫-৮ দিন। কাতান বেনারসির ফ্যাব্রিক হালকা হয়। আর স্যাটিন বেনারসি অনেকটাই ভারী হয়। অরগ্যাঞ্জা বেনারসি হলো ব্রোকেডের বেনারসি। যার ওজনও হালকা। বিভিন্ন মোটিফ দিয়ে বোনা হয় এই বেনারসি। পশ্চিমা বেনারসি উন্নতমানের সিল্ক দিয়ে তৈরি। কারোয়া বেনারসিতে বিভিন্ন বুটি দেখতে পাওয়া যায়। ফ্লোরাল মোটিফের কাজই এর বৈশিষ্ট্য। রেট্রো বেনারসির কদর এখন অনেক। বিভিন্ন রকম সুতোর কাজ করা থাকে এতে। সোনালি বা রুপোলি জরির কাজ বেশি দেখা যায় এতে। বিভিন্ন রকম সুতোর কাজ থাকে এই বেনারসিতে।
বিয়েতে-উৎসবে
বর্তমানে বিয়ে-শাদীতে নানারকম শাড়ি, লেহেঙ্গার চলন আসলেও বেনারসি শাড়ির আবেদন কমেনি আজও। আজকাল অনেকে মসলিন, টিস্যু বিভিন্ন রকমের শাড়ি বা লেহেঙ্গা পরলেও তালিকায় একটা বেনারসি থাকা চাই-ই। এতে বাঙালিয়ানার পাশাপাশি মেলে নিজেকে অপরূপ দেখানোর অন্যরকম এক সুযোগ। মিরপুরের বেনারসি শাড়ি আমাদের দেশের মেয়েদের উৎসবের পোশাক হিসেবে সমাদর পেয়েছে, এখনো পাচ্ছে। কনের পোশাক হিসেবে এই শাড়ির ব্যবহার দেখা যায় স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ১৯৫৮ সাল থেকে। সাধারণত বিয়েতে পরার জন্য বেনারসি শাড়িই সবচেয়ে উপযুক্ত। ঘন কাজ করা বেশ ভারী ধরনের এই শাড়িগুলো গরমে পরার জন্য ততটা উপযুক্ত নয়। কিন্তু এক ধরনের আভিজাত্য ফুটিয়ে তোলে ষোলআনা। মানুষের মাঝে এখন একটি ধারণা হয়ে গেছে, বিয়ে মানেই লাল বেনারসি শাড়ি। যদিও ফ্যাশনে ভিন্নতার হাওয়া লেগেছে এখন। ফলে লালের পাশাপাশি ম্যাজেন্টা, নীল, ময়ূরপঙ্খি নীল, রানি গোলাপি, গাঢ় বেগুনি ইত্যাদি রঙের শাড়িও পরছেন নতুন কনে। এগুলো বিয়েতে যেমন পরা যায় তেমন নানা উৎসবে পরা যায়।
এস/ আই. কে. জে/