বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিবিসি প্রতিবেদন

'আমার মা বাঈজি ছিলেন, কিন্তু তার ছিল ব্যক্তিত্ব আর সৎ সাহস’

বিনোদন ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০১:১৪ অপরাহ্ন, ২৬শে জুলাই ২০২৩

#

রেখাবাঈ, ১৯৯০এর দশকে তোলা ছবি ।। ছবি: বিবিসি বাংলা

"আমি অন্ধকারে নাচতাম। মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘর আলো করে আমার নাচ হতো। নিষ্প্রদীপ মহড়ার মধ্যেও আমার ভাগ্য ছিল উজ্জ্বল।"

সেটা ছিল ১৯৬২ সাল। সীমান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে ভারত ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল। ভারতীয় সরকার তখন দেশ জুড়ে ঘোষণা করেছিল জরুরি অবস্থা। মানুষের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল। যখন তখন সাইরেন বেজে ওঠা আর কয়েকদিন ধরে চলা নিষ্প্রদীপ মহড়া বা ব্ল্যাকআউট তখন পরিণত হয়েছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়। ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে দেখা দিয়েছিল অনিশ্চয়তা।

কিন্তু রেখাবাঈ সেই মৃত্যুভয়কে তার জীবনকে গ্রাস করার সুযোগ দেননি। অনেক বাঈজিই তখন তাদের বিনোদনের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রেখাবাঈ তা করেননি। রাতের পর রাত তিনি সুন্দর শাড়ি পরে তার 'কোঠা'য় আগত পুরুষদের সামনে নাচ-গান করতেন।

পেশাদার 'তওয়াইফ' নারীরা যেসব বাড়িতে পুরুষদের জন্য নাচ-গান করেন সেসব বাড়িকে হিন্দিতে বলা হয় 'কোঠা' - যা এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বেশ্যালয় অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

মায়ের 'কোঠা'র জীবন নিয়ে ছেলের বই

রেখাবাঈ তার জীবন থেকে এ শিক্ষাই পেয়েছিলেন যে কঠোর পরিশ্রম করলে আপনি অন্তত বেঁচে থাকতে তো পারবেনই, কখনো কখনো তা অনেক সুযোগের দরজাও খুলে দেবে।

তার ঘটনাবহুল জীবন এখন একটি বইয়ের বিষয়বস্তু। সে বই লিখেছেন তারই ছেলে মনীশ গায়কোয়াড়। বইটির নাম 'দ্য লাস্ট কোর্টেজান - রাইটিং মাই মাদার্স মেমোয়ার।'

"আমার মা সবসময়ই চাইতেন তার জীবনের গল্প বলতে" - বলছেন গায়কোয়াড়, সাথে যোগ করলেন যে এসব ঘটনা বর্ণনা করতে তিনি কখনো লজ্জা বা সংকোচ বোধ করতেন না।

মনীশ গায়কোয়াড় তার বয়স সতেরো-আঠারো হওয়া পর্যন্ত তার মায়ের সঙ্গে সেই কোঠাতেই বড় হয়েছেন। তাই তার জীবন ছেলের কাছে গোপন করার মত কিছু ছিল না।

"একটা কোঠাতে বড় হলে একটি শিশু এমন অনেক কিছুই দেখতে পায় যা হয়তো তার দেখা উচিত নয়। আমার মা তা জানতেন এবং তিনি কোনও কিছু গোপন করার কোনও প্রয়োজন বোধ করেননি" বলছিলেন গায়কোয়াড়।

মনীশ গায়কোয়াড়ের বইটি লেখা হয়েছে তার কাছে বর্ণনা করা তার মায়ের স্মৃতি থেকে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি একজন ভারতীয় 'তওয়াইফ'-এর জীবন কেমন ছিল তা এমন সততার সাথে এ বইতে তুলে ধরা হয়েছে যা পড়লে হতবাক হতে হয়।


মুম্বাইয়ের কংগ্রেস হাউজ কোঠায় তোলা ১৯৮০র দশকের একটি ছবি।। ছবি: বিবিসি বাংলা

'তওয়াইফ' সংস্কৃতির ইতিহাস বহু পুরোনো

ভারতে পেশাদার নাচ-গান করেন এমন নারীদের সাধারণভাবে বলা হয় তওয়াইফ। ভারতীয় উপমহাদেশে এ সংস্কৃতি চলছে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে - বলছেন ওড়িশি নৃত্যশিল্পী মাধুর গুপ্তা। তিনিও এই তওয়াইফ সংস্কৃতি নিয়ে একটি বই লিখেছেন।

"তারা ছিলেন নারী বিনোদনকারী - যাদের কাজ ছিল দেবতা এবং রাজাবাদশাদের বিনোদন এবং আনন্দ দেয়া" বলেন তিনি।

ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হবার আগে এই 'বাঈজি'দের দেখা হতো সম্মানিত শিল্পী হিসেবে। তারা নাচগানের মত কলায় ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী, ধনী এবং সে সময়কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুরুষদের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন তারা।

"কিন্তু তারা আবার পুরুষদের ও সমাজের শোষণেরও শিকার হতেন" - বলেন মিজ গুপ্তা।

ব্রিটিশ শাসনের সময় এই তওয়াইফ সংস্কৃতির অবক্ষয় শুরু হয়। ইংরেজরা তাদের ভাষায় এই 'নাচ গার্ল'-দের যৌন কর্মীর বেশি কিছু মনে করতো না। তারা এই প্রথা নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কিছু আইন কার্যকর করেছিল। এর পর ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পর তাদের সামাজিক অবস্থান আরো নিচে নেমে যায়। অনেক তওয়াইফই তখন টিকে থাকার জন্য দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হন।

এই প্রথা এখন সম্পূর্ণই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তবে বিখ্যাত কিছু তওয়াইফ ও তাদের বর্ণাঢ্য জীবনের কাহিনি টিকে আছে বইয়ের পাতায় আর সিনেমায়। রেখাবাঈয়ের জীবনও এমনি এক কাহিনি।

রেখাবাঈয়ের বিচিত্র জীবন


রেখাবাঈ, ১৯৯০এর দশকে ।। ছবি: বিবিসি বাংলা

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পুনেতে এক দরিদ্র পরিবারে রেখাবাঈয়ের জন্ম। বাবা-মায়ের ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। রেখাবাঈ তার জন্মের সঠিক বছর বা তারিখ মনে করতে পারেন না। পর পর পাঁচটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ার ক্ষোভে তার মদ্যপ পিতা রেখাবাঈকে জন্মের পরই পুকুরে ফেলে দিতে চেষ্টা করেছিলেন।

পরিবারের ঋণ শোধ করার জন্য রেখাবাঈকে ৯-১০ বছরেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। পরে তার স্বামীর আত্মীয় স্বজনরাই তাকে কোলকাতা শহরের বউবাজার এলাকায় এক কোঠাতে বিক্রি করে দেয়।

তওয়াইফ হিসেবে রেখাবাঈয়ের গান ও নাচ শেখা শুরু হয় তার বয়স ১৩-র কোঠায় পড়ার আগেই। তবে তার জীবন ও উপার্জন নিয়ন্ত্রণ করতেন একজন আত্মীয়া - যিনি নিজেও সেখানে একজন তওয়াইফ ছিলেন।

ভারত-চীন যুদ্ধের সময় সেই আত্মীয়া অন্যত্র চলে গেলে রেখাবাঈ তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নেবার সুযোগ পান।

মোমবাতির আলোয় তার নাচ-গানের অনুষ্ঠানগুলো তাকে স্বাথীন জীবন এনে দেয় এবং তার মনে এই উপলব্ধি আসে যে - সাহস থাকলে তিনি তার নিজের জীবিকা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেই করতে পারবেন। বাকি জীবন ধরে এটাই তার মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়।

আর কখনো বিয়ে করেননি রেখাবাঈ


তওয়াইফদের জীবন নিয়ে তৈরি ছবি গঙ্গুবাই কাথিয়াড়ির একটি দৃশ্য ।। ছবি: বিবিসি বাংলা

বলিউডের ছবি 'উমরাও জান' আর 'পাকিজা'তে যেমন আছে - রেখাবাঈ কখনো তা করেননি অর্থাৎ কোনও পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেননি, জীবনে আর কখনো বিয়ে করেননি।

তবে তার অনেক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন যারা তার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইতেন। তাদের মধ্যে ছিঁচকে অপরাধী থেকে ধনী শেখ, বা নামকরা সঙ্গীতশিল্পী পর্যন্ত অনেকেই ছিলেন। কিন্তু রেখাবাঈ এতে সাড়া দেননি কারণ তার অর্থ হতো তার তওয়াইফের জীবন এবং এই কোঠা ত্যাগ করা।

সেই ছোট ঘর - যাতে তিনি নাচ-গানের অনুষ্ঠান করতেন, বাস করতেন, সন্তানকে বড় করেছিলেন এবং যেখানে তিনি তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বিভিন্ন সময় আশ্রয় দিয়েছেন - তা হয়ে উঠেছিল তার জন্য স্বাধীনতা ও শক্তির প্রতীক।

কিন্তু এই কোঠা একই সাথে ছিল এমন একটি জায়গা যেখানে লেগে থাকতো সংঘাত আর দুর্দশা। সেখানকার পরিবেশ মানুষের নিষ্পাপ মানবতাকে বিনষ্ট করে দেয় - তার ভেতরে জাগিয়ে তোলে ক্রোধ, ভয় আর হতাশার মত ধ্বংসাত্মক আবেগ।

মর্মান্তিক স্মৃতি

গায়কোয়াড় তার বইয়ে তুলে ধরেছেন মর্মান্তিক কিছু স্মৃতি যা তার মা তার কাছে বর্ণনা করেছিলেন। তার একটি হলো, এক গুণ্ডা তার মাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করায় সে বন্দুক বের করে তাকে গুলি করতে উদ্যত হয়েছিল।

বইয়ের আরেক জায়গায় রেখাবাঈ বর্ণনা করেছেন তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হওয়ায় অন্য তওয়াইফদের যে নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে - সেই গল্প।

এই তওয়াইফদের কেউ কেউ তার ঘরের বাইরে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছিলেন। কেউ কেউ তাকে ডাকতেন 'বেশ্যা' বলে - যদিও তিনি তা ছিলেন না।

তার ছিল পুরুষদের ওপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা

কিন্তু এই কোঠাই আবার রেখাবাঈয়ের মধ্যে এক দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিল। এখানেই তিনি তার নাচের প্রতিভা আবিষ্কার করেছিলেন। যে পুরুষরা তাদের দুঃখ ভুলতে তার কাছে আসতো - তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম ছিল রেখাবাঈয়ের নাচ।


মুম্বাইেত নির্মিত বিখ্যাত ছবি পাকিজা'র পোস্টার ।। ছবি: বিবিসি বাংলা

পুরুষরা তার সাথে কেমন আচরণ করছে - তা থেকে তারা কে কেমন লোক তা বুঝতে শিখেছিলেন তিনি। তিনি প্রয়োজনে তাদের তোয়াজ করতে পারতেন, আবার তাদের ছিন্নভিন্ন করতেও জানতেন।

রেখাবাঈ বলতেন, "আমি কোঠার ভাষা শিখেছি, দরকার হলে আমাকে তা বলতে হতোা"

একদিকে তিনি যেমন ছিলেন আকর্ষণীয় ও বুদ্ধিমতী তওয়াইফ - আবার অন্যদিকে স্নেহময়ী মা হিসেবে তার সন্তানের উন্নত জীবন নিশ্চিত করার জন্য সবকিছুই করতেন তিনি।

স্নেহময়ী মা

তার ছেলে যখন ছোট ছিল, তখন তাকে কোঠায় তার কাছেই রাখতেন তিনি। তাকে কাঁদতে শুনলে নাচগানের অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকেই গিয়ে ছেলেকে দেখে আসতেন।

পরে তিনি ছেলেকে একটি বোর্ডিং স্কুলে পাঠান, আর আরো পরে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন - যাতে সে তার বন্ধুদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে লজ্জা বোধ না করে।

তার ছেলে যেভাবে বড় হচ্ছে তাতে তিনি গর্ব বোধ করতেন। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা এবং বোর্ডিং স্কুলের মার্জিত পরিবেশে বড় হবার কারণে অবশ্য ছেলে ও মায়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছিল।

বইতে এক জায়গায় আছে, স্কুলের ছুটিতে মায়ের সাথে থাকতে এসে তার ছেলে খাবার সময় কাঁটা-চামচ চেয়েছিলেন। রেখাবাঈ বলছেন, তিনি কাঁটা কী তা জানতেন কিন্তু তাকে যে ইংরেজিতে ফর্ক বলে তা জানতেন না। ছেলে তাকে বুঝিয়ে দেবার পর তিনি বাজারে গিয়ে তা কিনে এনেছিলেন।

দু'হাজার সালের পর তওয়াইফ সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। রেখাবাঈ তখন কোঠা ছেড়ে কোলকাতায় তার অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতে শুরু করেন। ফেব্রুয়ারি মাসে মুম্বাই শহরে তিনি মারা যান।

গায়কোয়াড় বলেন, তার মায়ের প্রতিভা, দৃঢ়তা আর জীবনবোধ তাকে মুগ্ধ করতো।

আরো পড়ুন: সম্পর্কে ভাগ্নিকে বিয়ে করেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা

"আমি চাই যেন পুরুষরা এ বইটি পড়েন" বলছেন তিনি, -"ভারতীয় পুরুষরা মা সম্পর্কে এমন একটি ধারণা তৈরি করেছেন যেখানে তাকে শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি করে গড়ে তোলা হয়।"

"কিন্তু আমি আশা করছি এই বইটি মানুষকে তাদের মায়েদের অনন্য বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে - যাতে তারা সন্তানের সাথে সম্পর্কের বাইরে গিয়ে তাকে দেখতে পারে এবং তিনি যা ছিলেন সেভাবেই তাকে মেনে নিতে পারে।"

সূত্র: বিবিসি বংলা

এম এইচ ডি/ আই. কে. জে/ 


বিনোদন নারী অধিকার সমাজ যৌন সহিংসতা পরিবার সংস্কৃতি রেখাবাঈ

খবরটি শেয়ার করুন