বৃহস্পতিবার, ২৮শে আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১২ই ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরলে কখন থেকে কার্যকর হবে—প্রশ্ন প্রধান বিচারপতির *** শাহবাগে এসে শিক্ষার্থীদের কাছে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’ *** ২৮ তারিখ নয়, রাকসুর ভোট গ্রহণ ২৫শে সেপ্টেম্বর *** গাজা যুদ্ধের কভারেজ নিয়ে ক্ষুব্ধ সাংবাদিক ঘোষণা দিয়ে রয়টার্স ছাড়লেন *** ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল রিজার্ভ *** জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামা সংশোধন করবে কমিশন *** পান্নুন হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রে জড়িত ‘র’–এর সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দিল্লিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা *** বেসরকারি খাতে যাচ্ছে নগদ, এক সপ্তাহের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি: গভর্নর *** নেপালের বিপক্ষে এগিয়ে থেকে বিরতিতে বাংলাদেশ *** চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘিরে উসকানির চিহ্ন দেখামাত্র ব্যবস্থা নিতে তিন উপদেষ্টার নির্দেশ

ব্যক্তিগত ‘দুঃখপ্রকাশে’ পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান হয়নি

জেবিন শান্তনু

🕒 প্রকাশ: ০৯:৪৭ অপরাহ্ন, ২৫শে আগস্ট ২০২৫

#

পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কিছু বিষয় অমীমাংসিতই রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি দুই নেতার ঢাকায় সফরে এসে ব্যক্তিগতভাবে 'দুঃখপ্রকাশের' মধ্য দিয়ে বিষয়গুলোর মীমাংসা হয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে তারা সুখবর ডটকমকে জানান। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় সফরে এসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভাতৃবিরোধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে 'বিষয়গুলো মীমাংসিত' দাবি করে দেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগকে ‘অপমান' করেছেন বলে মন্তব্য করেন তারা।

তবে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার তার ৩৬ ঘণ্টার বাংলাদেশ সফরকে ‘অত্যন্ত ফলপ্রসূ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এই সফর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন গতির সঞ্চার করবে। আরও সফর বিনিময়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়বে। দেশের ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসহাক দার মুক্তিযুদ্ধকে 'ভাতৃবিরোধ' হিসেবে আখ্যায়িত করে সত্য ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয় বা ইস্যু ‘দুইবার সমাধান হয়েছে’ বলে তার দাবির সঙ্গে একমত নন তারা।

তাদের মতে, ইতিহাস বিকৃত করে বা মুক্তিযুদ্ধকে 'ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত' বলে অভিহিত করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই সুস্থ ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রধান তিনটি বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সেগুলো হলো- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চালানো গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা, স্বাধীনতার সময়কার পাকিস্তানের সম্পদের সুষম বণ্টন এবং দুই দেশের আটকে পড়া নাগরিকদের প্রত্যাবাসন। এসব বিষয় নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময় দুই দেশের মধ্যে নানা আলাপ-আলোচনা হতে দেখা গেলেও দৃশ্যমান কোনো সমাধান দেখা যায়নি।

গত শনিবার (২৩শে আগস্ট) পাকিস্তানের মন্ত্রী ইসহাক দার রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এলে নতুন করে ইস্যুগুলো সামনে আসে এবং সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন মহল থেকে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। কিন্তু পরদিন রোববার সকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো অতীতে 'দুই দফায় সমাধান' করা হয়েছে। তার এমন দাবিতে বিস্মিত বিশ্লেষকেরা।

জানা যায়, একাত্তরে  স্বাধীনতা অর্জনের দুই বছরের বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়  পাকিস্তান। এ ঘটনার মাত্র চার মাসের মাথায় শতাধিক ব্যক্তির বিশাল এক বহর নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেন পাকিস্তানের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো, পরে পাকিস্তানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যু কার্যকর করেন দেশটির আরেক সামরিক শাসক।


সেই সফরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় কথিত 'তওবা' বা অনুশোচনা প্রকাশ করে সেটির জন্য এককভাবে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকদের দায়ী করেন ভুট্টো। বিষয়টিকে 'বেদনাদায়ক' বর্ণনা করে সেটির ইতি টেনে তখন দুই দেশের মধ্যে 'স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ' সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকায় ভুট্টো বলেছিলেন, 'যা হয়েছে, তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।' তবে ভুট্টোর ওই 'তওবা' কোনোভাবেই পাকিস্তানের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ক্ষমাপ্রার্থনা ছিল না, তা ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০২২ সালে পাকিস্তানের ফৌজি শাসক ও প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ ঢাকা সফরে এসে পুনরায় 'দুঃখপ্রকাশ' করেন ব্যক্তিগতভাবে। তার এই 'দুঃখপ্রকাশ'ও পাকিস্তানের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ছিল না। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার সাবেক অবিভক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ভাগ চাওয়া হলেও পাকিস্তানের কোনো সরকারই সেটি বুঝিয়ে দেয়নি। ১৯৭৪ সালে বিষয়গুলো নিয়ে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বিশেষত দায় ও সম্পদের বণ্টন প্রশ্নে পাকিস্তান অযৌক্তিক মনোভাব প্রকাশ করার কারণে আলোচনা ভেস্তে গেছে বলে সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ফলে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

আমেরিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির এসব প্রসঙ্গে বলেন, 'একাত্তর সালে এখানে গণহত্যার দায়, পাকিস্তানিদের এই দায়টা স্বীকার করতে হবে এবং সেটার জন্য আকারে-ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে তারা বলেছে। কিন্তু আমরা চাই যে, তারা এই দায়িত্বটা নিয়ে প্রকাশ্যে এর একটা সমাধান করুক।'

সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, '১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে আসেন, তখন তিনি ব্যক্তিগতভাবে সরি বলেছেন। কিন্তু তিনি কোনো দায় নেননি। আমরা মনে করি, এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। বাংলাদেশ চাই, পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চাক, সেটা হয়নি৷ এটা আসলে পাকিস্তান পার্লামেন্টে রেজ্যুলেশন নিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে৷ অথবা কোনো যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে এটা হতে পারে৷ আবার ২০০০ সালে পারভেজ মোশররফও একইভাবে সরি বলেছেন৷ আসলে কোনোটাই ক্ষমা চাওয়া হয়নি।'

তিনি আরো বলেন, 'ক্ষমা চাইলে প্রথমে দোষ স্বীকার করতে হয়। তারা যে গণহত্যা করেছে, সেটা স্বীকার করবে, এই ধরনের কাজ আর করবে না, এসব বলে তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াই কেবল গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি৷'


যোগাযোগ করলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো একাত্তরের গণহত্যার জন্য কোনো ক্ষমা চায়নি৷ ক্ষমা চাওয়ার একটা প্রক্রিয়া আছে৷ সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে হতে হয়। পাকিস্তান সেটা একটি যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে করতে পারে। অথবা সংসদে রেজ্যুলেশন পাশ করে করতে পারে৷ এখনো তো অনেক দেশ ক্ষমা চাইছে৷ জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স তো এখনো ক্ষমা চাচ্ছে। জাপান তো একধিকবার ক্ষমা চেয়েছে। আমি জানি না, তারা কেন বারবার একাত্তরে এসে আটকে যাচ্ছে৷'

ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের পূর্ববর্তী সময়কার পাওনা দাবি করে আসছে৷ কিন্তু তা নিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি৷ ইমিতয়াজ আহমেদ বলেন, 'আমাদের পাওনা বেশি নয়, চার বিলিয়ন ডলার। আর ওটা তো বাংলাদেশরই অর্থ। প্রধানত পেনশনের টাকা ওখানকার ব্যাংকে জমা আছে। আমরা তো সেটাই চাচ্ছি৷ সুদে-আসলে তো ফেরত চাইছি না৷ আমি জানি না, এটা ফেরত দিতে তাদের সমস্যা কোথায়৷'

পাওনা সম্পদ ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ ‘আটকে পড়া' উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী বলেন, 'পাকিস্তানের আরো উদার হওয়ার প্রয়োজন আছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো এগিয়ে নিতে। পাকিস্তান মুখে যাই বলুক, দেশটি অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে তাদের অবস্থান বদলাচ্ছে না।'

অধ্যাপক ইমতিয়াজও মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে৷ এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল বা সাফটার বাইরে গিয়েও দ্বিপাক্ষিক কাঠামো হতে পারে৷ তিনি বলেন, 'তবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ৷ ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চাইবেন, কম্পারেটিভ সুবিধা নিতে। সেটা যেভাবেই হোক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়লে দুই দেশের জনগণেরই লাভ হবে৷'

বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া এ প্রসঙ্গে বলেন, 'সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের বক্তব্য বাংলাদেশের জনগণকে গভীরভাবে ব্যথিত ও বিব্রত করেছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে ভাতৃবিরোধ হিসেবে আখ্যায়িত করে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগকে অপমানিত করেছে।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭১ কোনো ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ছিল না-এটি ছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের দমন-পীড়ন, ঔপনিবেশিক শোষণ ও পৈশাচিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। মৌখিক দুঃখপ্রকাশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হলে পাকিস্তানকে মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে হবে। দেশটির দায়ী জেনারেল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইতিহাস বিকৃত করে বা মুক্তিযুদ্ধকে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বলে অভিহিত করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই সুস্থ ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে না।’

ইসহাক দার এম হুমায়ুন কবির ইমতিয়াজ আহমেদ

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন