ছবি : সংগৃহীত
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে/ জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে, নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/ এই বাংলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা...।’
কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতা একাত্তর সালের ১৬ই ডিসেম্বর সত্যি হয়ে বাঙালি জাতির জীবনে দেখা দিয়েছিল। এই দিনে বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে।দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। তার আগে ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল জনসভায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্পষ্ট স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এটাই ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা।
১৯৪৭ সালে ইংরেজদের পতনের মধ্যদিয়ে ১৪ই ও ১৫ই আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ইংরেজদের কাছ থেকে পাওয়া স্বাধীনতা বাঙালি জাতিকে সুখ-শান্তি তথা মুক্তি দেয়নি। বাঙালিদের ওপর নেমে আসে পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসন, বঞ্চনা ও শোষণের খড়গ। দুই পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাঙালি হওয়ার পরও তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হতে হয়েছিল। বাঙালিরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য ও শোষণের শিকার হয়েছিল।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে চলে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় (১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ) বাঙালিদের পৌঁছে দেয় তাদের স্বপ্নের গন্তব্য--মাহেন্দ্রক্ষণ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে।
দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানিদের শোষণ, বঞ্চনা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বীর বাঙালিরা মুক্তির লক্ষ্যে জেগে উঠেছিল। তাদেরকে চিরতরে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে ঘুমন্ত-নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। নির্বিচারে তারা অগণিত মানুষকে হত্যা করে। ইতিহাসের এই বর্বরতম গণহত্যাও বাঙালিদের স্তব্ধ করতে পারেনি। বরং অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে জ্বলে ওঠেছিল।
২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।ওয়ারলেসের মাধ্যমে ঘোষণাটি সমগ্র দেশে পাঠানো হয়।রাতেই সারাদেশে পৌঁছে যায়। তারপর চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬শে মার্চ দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রথম পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা তৎকালীন এমএনএ এমএ হান্নান। পরদিন ২৭শে মার্চ, সন্ধ্যা সাতটায় ওই বেতার কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি তখন ছিলেন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা।সে জন্যই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার ঘোষণাটা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আল বদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যদের অত্যাচার-নির্যাতন পৃথিবীর ইতিহাসে সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছিল। পশুর মতো তারা নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নৃশংস এইসব বর্বরতাও বাঙালিদের দমাতে পারেনি। ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী। এমনি করেই শেষ পর্যন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।দীর্ঘ ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, ৩ লাখেরও অধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, এক কোটির বেশি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সেটি আবার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে উদিত হয়।।বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের দিন। বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তিতে তোমাকে অভিবাদন, হে বাংলাদেশ।