ছবি: সংগৃহীত
কুমিল্লার মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুরে হিন্দুধর্মাবলম্বী এক নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সঙ্গে ঘটনায় অভিযুক্ত দুষ্কৃতকারীরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক উপদেষ্টার আশকারা পাচ্ছেন বলে মির্জা ফখরুল আজ রোববার (২৯শে জুন) জাতীয় গণমাধ্যমের কার্যালয়ে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করেন।
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, ধর্ষণে অভিযুক্ত ফজর আলী মুরাদনগরের ১১ নম্বর দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা গোলাম কিবরিয়ার দেহরক্ষী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনি একজন সক্রিয় আওয়ামী লীগ কর্মী এবং দলটির নানা মিছিল-মিটিংয়ে তার অংশ নেওয়ার ছবি ও ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির রোববার নিজের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে দাবি করেন, মুরাদনগরের রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়নে হিন্দু এক নারীকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় জামায়াত-শিবির চক্র বিএনপির বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপপ্রচার চালাচ্ছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের সমর্থক কিছু ফেসবুক পেজ ও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার পোস্ট থেকে ধর্ষণের ঘটনার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপির স্থানীয় নেতা উল্লেখ করে প্রচার শুরু করলে বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে তা প্রত্যাখ্যান করে দাবি করা হয়, 'অভিযুক্ত ব্যক্তি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন'।
আবার এ ঘটনার জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার দিকে ইঙ্গিত করে অনেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা করে নানা পোস্ট দেন। আরেকটি পক্ষ ঘটনাটিকে 'পরকীয়া সম্পর্কের জের' হিসেবে প্রচার চালাতে শুরু করেন ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমন নানামুখী প্রচার ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং দোষারোপের মধ্যে আজ ভোরে মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে গ্রেপ্তারের তথ্য দেয় পুলিশ।
প্রশ্ন উঠেছে, ফজর আলীকে রক্ষার জন্য কী কোনো গোষ্ঠী এমন পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছেন? আবার মির্জা ফখরুল যে বলেছেন, একজন উপদেষ্টার আশকারা পাচ্ছেন মুরাদনগরের ধর্ষক ও ভিডিওকারী, নির্যাতকরা, সেই উপদেষ্টার নাম কি? বিবৃতিতে অবশ্য বিএনপির মহাসচিব ওই উপদেষ্টার নাম উল্লেখ করেননি।
মূল অভিযুক্তের রাজনৈতিক পরিচয়ের সূত্র ধরে নানামুখী প্রচার দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমেও। তবে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সুখবর ডটকম কথা বলে নানা ধরনের বক্তব্য পেয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীকে ধর্ষণ ও সহিংসতার অভিযোগের ঘটনায় বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, এ ঘটনা নারীর প্রতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ এবং বিদ্বেষের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ; যা দেশের সংবিধান, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে লঙ্ঘন করে। এর জন্য শুধু ব্যক্তি নয়; সরকারের নির্লিপ্ততা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে আসক।
কেউ কেউ মনে করেন, এক উপদেষ্টার আশকারা পাচ্ছেন মুরাদনগরের দুষ্কৃতকারীরা বলে মির্জা ফখরুল যে বিবৃতি দিয়েছেন, তিনি সম্ভবত যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। মুরাদনগর আসিফ মাহমুদের নিজের উপজেলা। ইতিমধ্যে একাধিকবার উপদেষ্টা, তার বাবা ও এক চাচাতো ভাইয়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের অভিযোগ করে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি। উপদেষ্টার 'পদত্যাগ'ও দাবি করে তারা। একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মরক্কো অবস্থান করায় এ প্রসঙ্গে আসিফ মাহমুদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
বিএনপির আগের অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমকে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মুরাদনগর এলাকার সাবেক একজন সংসদ সদস্যের অনুসারীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব করছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে বলেন, 'একজন উপদেষ্টা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুরাদনগরে ক্রমাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন। হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীকে শ্লীলতাহানি ও নির্যাতন এক নির্মম কলঙ্কজনক ঘৃণ্য ঘটনা। এমন বর্বরোচিত ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যথিত ও মর্মাহত করেছে। একটি কুচক্রী মহল এ কাপুরুষোচিত ন্যক্কারজনক ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এক গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।'
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া মুঠোফোনে এ প্রসঙ্গে সুখবর ডটকমকে বলেন, 'ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিএনপির কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। আওয়ামী লীগ ও এনসিপির কিছু নেতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও ব্যর্থতা আড়াল করতে পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে। আওয়ামী লীগ ও এনসিপির কিছু নেতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও ব্যর্থতা আড়াল করতে পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে।'
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ঘটনাটি বৃহস্পতিবারের (২৬শে জুন) হলেও এটি ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় গতকাল শনিবার (২৮শে জুন)। এরপর এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কুমিল্লার পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খান স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, 'ভিকটিম বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসার পর এ ঘটনা ঘটে।' তার বক্তব্যের রেকর্ড সুখবর ডটকম সংগ্রহ করেছে।
মুরাদনগরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মুরাদনগর সার্কেল) এ কে এম কামরুজ্জামান আজ সুখবর ডটকমকে মুঠোফোনে বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে অনেকে বিষয়টি পরকীয়া বলে প্রচার করছেন। আমাদের প্রাথমিক তদন্তে এমন কোনো তথ্যে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রকৃত অর্থেই ওই নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।'
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মাগুরার ধর্ষণকাণ্ডের মতো মুরাদনগরের ঘটনার বিচারও ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সময়ে’ সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'মুরাদনগরে যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা সবাই মর্মাহত; ক্ষুব্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে। যারা ছবিগুলো ছড়িয়ে দিয়েছেন, তারা অত্যন্ত দায়িত্বহীন কাজ করেছেন। সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।'
খবরটি শেয়ার করুন