শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সোনালী দিন শেষে আবার কি আশার আলো দেখাচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র?

বিনোদন ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৭:৫৭ অপরাহ্ন, ১৩ই এপ্রিল ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র যেমন বিনোদনের মাধ্যম তেমনি তথ্য, শিক্ষা এবং প্রচার-প্রভাব-প্রসারমূলক মাধ্যমও। এ মাধ্যমটি জনমনে রুচি ও প্রত্যাশা সৃষ্টির মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যায়। এক কথায় চলচ্চিত্র হচ্ছে মানব জীবনের দর্পণ স্বরূপ।

চলচ্চিত্র একটি নান্দনিক শিল্প মাধ্যমও বটে।  চলচ্চিত্রের মাধ্যমে একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বরূপের বহি:প্রকাশ ঘটে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যা এখনো মানুষের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে। আশির দশক পর্যন্ত এদেশের চলচ্চিত্রের সোনালী দিন ছিল। 

মূলত নব্বই দশক এর পর হতেই আমাদের চলচ্চিত্র ফ্যাকাশে বর্ণ লাভ করতে থাকে। এক সময় আমাদের দেশে প্রায় ১৫০০ মত সিনেমা হল ছিল কিন্তু বর্তমানে জরাজীর্ণ মাত্র ২৭৪টি সিনেমা হল রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ২৫ জেলা সিনেমা হল শূন্য। এক সময় লক্ষাধিক লোকের জীবন-জীবিকা নির্ভর করত এই চলচ্চিত্রের উপর। 

১৯৬০-১৯৯০ বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ ছিল তবে ২০০০-২০০৬ বাংলা সিনেমার অন্ধকার যুগ । 


এই সময়টাতেই  সিনেমাতে অশ্লীলতা ভর করে। ফলে দর্শক সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এই সময়ে দেশে ৪০০ অশ্লীল সিনেমা তৈরি হয়। অশ্লীলতার জন্য অনেক গুণী পরিচালক সিনেমা তৈরি থেকে সরে আসতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ পরিচালক ছিলেন ৯০ দশকের ব্যবসাসফল সিনেমার পরিচালক (আমজাদ হোসেন, এজি মিন্টু, শহীদুল ইসলাম খোকন) ইত্যাদি। অশ্লীল সিনেমাগুলো মূলত ক্ষমতার জোরেই রাতের অন্ধকারে তৈরি হতো।

২০০৬ সালের শেষের দিকে দর্শক, সরকার ও সুধী সমাজের টনক নড়ে উঠতে শুরু করলো অশ্লীল সিনেমার বিরুদ্ধে। সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখী শুরু হলো অশ্লীল সিনেমার বিরুদ্ধে।

২০০৭ সালের শুরুর দিকে অশ্লীল সিনেমার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলো যার নেতৃত্বে ছিলেন নায়ক মান্না এবং তার সাথে যুক্ত হলেন মালেক আফসারী ও ডিপজলের মতো সিনেমা শুভাকাঙ্খীরা।

তাদের এই আন্দলনের ফলে অশ্লীলতা দূর হতে শুরু করলো এবং অনেকে নিষিদ্ধ হতে শুরু করলো। বেদের মেযে জোসনা, মনপুরা, আয়নাবাজি, ঢাকা এট্যাকের মতো ব্যবসা সফল সিনেমা কিন্তু আমাদের দেশেই তৈরি হচ্ছে। আমরা যদি চলচিত্র সচেতন হতে পারি বা হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করি তাহলে অশ্লীল চলচিত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাহস পাবে না

তবে বিগত পাঁচ বছরে বিশেষ করে ২০২০-এ এসে চলচ্চিত্রশিল্প কোভিড-১৯ মোকাবেলা করে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির কারণে ২০২০ সালে অনান্য শিল্পখাতের মতো চলচ্চিত্র শিল্পেও ব্যাপক ধস নামে। সিনেমা হল বন্ধ থাকায় চলচ্চিত্র মুক্তির পরিমাণ কমে যায়।

এই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে তার জীবনী নিয়ে নির্মিত হয় একাধিক চলচ্চিত্র। তন্মধ্যে রয়েছে ‘টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’, ‘আগস্ট ১৯৭৫’ ‘চিরঞ্জীব মুজিব’। টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই’ শেখ মুজিবের কৈশোরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি নিয়ে নির্মিত। ‘আগস্ট ১৯৭৫’ বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ অনুসারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীদিনের ঘটনাবলির চিত্রায়ণ। অন্যদিকে, ‘চিরঞ্জীব মুজিব’ শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ অবলম্বনে নির্মিত হয়। এছাড়া সর্বশেষ  ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ ছবিটি ২০২৩ এর শেষদিকে সাড়া জাগায়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে এসে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন ’রেহানা মরিয়ম নূর’-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল প্রতিযোগিতা পর্বে অংশগ্রহণ। কান চলচ্চিত্র উৎসবের লাল গালিচা এবং প্রদর্শনীতে নজর কেড়েছেন পরিচালক সাদ ও অভিনেত্রী বাঁধন। এ ছাড়া রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের ‘নোনা জলের কাব্য’ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিদেশি তহবিল পাওয়া ছবিও এটি। এ ছাড়া বুসানে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রথম ইংরেজি ভাষার সিনেমা ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ ও মোহাম্মদ রাব্বী মৃধার ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’।

তবে করোনা মহামারির কারণে ঘরবন্দী মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। আই থিয়েটার, বঙ্গ, বিঞ্জ, চরকি এসব ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো দর্শক টানতে শুরু করে। ২০২১ সালে এসে পুনরায় হল খুলে দিলেও হল সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেও সেগুলো আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারছে না। তবে সর্বশেষ গত ঈদে শাকিবের ‘প্রিয়তমা’ দর্শকদের হলে টানে এবং ব্যবসা সফল হয়। অন্যদিকে চঞ্চল চৌধুরীর ‘হাওয়া’ সিনেমাও মানুষকে হলমুখী করে দেশীয় চলচ্চিত্রে আশার আলো জ্বালিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পকে নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন রাজশাহী, বগুড়া ও চট্টগ্রামে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ হয়েছে। 

আরো পড়ুন: 

দেশীয় চলচ্চিত্রের মান এবং দর্শকদের নিয়মিত হলমূখী করতে আমাদের যে বিষয় গুলোর দিকে বিশেষ খেয়াল করতে হবে- 

১.বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অল্প খরচে ও অল্প সময়েই একটি চলচ্চিত্র নির্মান করা যায়। এতে করে অধিকমাত্রায় চলচ্চিত্র নির্মানের কারনে ছবির মান ঠিক থাকছে না। এদিকটা বিবেচনায় রাখতে হবে।

২.কোনটা নাটক আর কোনটা চলচ্চিত্র এটা এখন বুঝতে অনেক কষ্ট হয়। এর অর্থ হলো প্রযুক্তি হাতে পেয়ে সৃষ্টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, তাই ভালো চলচ্চিত্র মানুষ দেখতে পারছে না।

৩. কিছু ভালমানের ছবি নির্মিত হয়েছে তবে এর সংখ্যা অত্যন্ত কম। ভাল ছবির কদর সব সময়ই ছিল এবং এখনও আছে। তবে মনে রাখতে হবে একটা ভালমানের ছবি নির্মানের জন্য প্রথমেই একটা ভাল কাহিনীর প্রয়োজন, ভাল চিত্রনাট্য, দক্ষ কলাকুশলী ও কাহিনীর প্রেক্ষাপটে একটি ভাল লোকেশন প্রয়োজন। আর পরিচালক একজন দক্ষ নাবিকের ন্যায় যখন এই কাজগুলি করতে সক্ষম হন তখনই একটি ভালমানের ছবি নির্মান করা সম্ভব হয়। 

৪. বর্তমানের অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা নিজেদের বিরাট কিছু ভেবে তাদের ইচ্ছামত সুটিং করতে আসে এবং তাদের ইচ্ছা মত সুটিং ছেড়ে চলে যায়। এজন্য নির্মাতারা মনের মত করে চলচ্চিত্র নির্মান করতে পারছে না। বিধায় নির্মাতার লগ্নি করা টাকা ফেরৎ আসতেছে না ফলে নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মানের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে আর দর্শকরা বঞ্চিত হচ্ছে ভালোমানের ছবি দেখা হতে।

৫. দেরীতে হলেও আমাদের দেশেও বর্তমানে কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনয় সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেমন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রীন ইউনিভার্সিটি, জাতীয় গণমাধ্যম ইন্সটিটিউট, ফিল্ম ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ, ঢাকা ফিল্ম ইন্সটিটিউট অন্যতম। চলচ্চিত্র একাধারে শিল্প, অর্থনীতি ও প্রযুক্তি নির্ভর বিধায় এর সঙ্গে জড়িতদের পেশাগত শিক্ষা ও দক্ষতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

৬. উন্নত বিশ্বে যেকোন সরকারী ভবন বা স্থাপনায় স্যুটিং করার সুযোগ থাকলেও আমাদের দেশে এক্ষেত্রে ততটা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া গণমাধ্যমে এর প্রচার-প্রচারনায়ও রয়েছে নানাধরণের বিধিনিষেধ। সরকারকে এ বিষয় গুলোকে বিবেচনায় রাখতে হবে।

৭.যৌথ ছবি নির্মানের নীতিমালাগুলি মানতে হবে। নতুন পরিচালক ও প্রবীণ পরিচালকদের মধ্যে দুরত্ব কমাতে হবে। শিল্পী-কলাকুশলীদের তাদের কাজের মানের প্রতি আরও অধিকতর যত্নশীল হতে হবে আর দর্শকদের দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রের প্রতি আন্তরিক থাকতে হবে। আমাদের সিনেমা হলগুলির পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। 

পরিশেষে বলা যায়, যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের চলচ্চিত্রের কল্যাণে চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকার, কলাকুশলী ও গণমাধ্যমের অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।  আমাদের দেশেও অসংখ্য মেধাবী পরিচালক, শিল্পী রয়েছে কিন্তু কেবলমাত্র এদের মাঝে সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ভালমানের চলচ্চিত্র নির্মানের যে প্রচেষ্ঠা প্রয়োজন তা নেই। এই সমন্বয়ের বিষয়টিকে দেখতে হবে সরকারকে।

এসি/  আই.কে.জে


সোনালী দিন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

খবরটি শেয়ার করুন