ছবি- সংগৃহীত
রবিউল হক
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য হিসেবে ইসলামের ইতিহাসের মর্মান্তিক কারবালার যুদ্ধ ও ইমাম হাসান-হোসেনের বেদনাদায়ক কাহিনী অবলম্বনে দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই জারি গানের পরিবেশনা লক্ষ করা যায়। বিলাপের সুরে নৃত্যসহযোগে জারি গানের পরিবেশনা এখনো স্বকীয় আবেদন ধরে রেখেছে। যদিও কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা জারি গানের মূল উপজীব্য বিষয়, তথাপি জারি গানের বিষয়বস্তু হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
জারি গানের উৎপত্তি ও বিকাশ: জারি গানের উৎপত্তি হিসেবে পঞ্চদশ শতকের বৈঠকী ধারার ‘জঙ্গনামা’ পরিবেশনাকে ধরা হয়ে থাকে। তবে গবেষকদের ধারণা ‘জঙ্গনামা’ বৈঠকী রীতির পরিবেশনার মাধ্যমে বিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশের স্থানীয় সমাজে শোকগীতি হিসেবে জারিগান অনেক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
জারিগান পরিবেশনের সময়: যদিও মহররম মাসে জারিগানের মূল আয়োজন লক্ষ করা যায়, তবে বাংলাদেশে বর্তমানে সারাবছর জারিগানের আসর হয়ে থাকে। এছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও উৎসবাদিতে জারিগানের পরিবেশনা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
সম্মানি ও পৃষ্ঠপোষকতা: বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পৃষ্ঠপোষকতার বড়ই অভাব লক্ষ করা যায়। জারি গানের দলকে মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা সম্মানি প্রদান করা হয়ে থাকে।
জারিগানের আয়োজন: জারিগানের পরিবেশনা সাধারণত গ্রামের খোলা মাঠ, বাড়ির আঙিনায় হয়ে থাকে। জারিগানে চতুর্দিকে দর্শকের অবস্থান রেখে মাঝখানে দাঁড়িয়ে বা বসে গান করা হয়ে থাকে।
জারিগানের শিল্পী: জারিগানের দল কখনো ১০ থেকে ১৫ জনের আবার কখনো বা এর বেশিও হয়ে থাকে। তাদের নিজস্ব কিছু নামকরণও করা হয়ে থাকে। যেমন- প্রধান গায়ককে সাধারণত ‘বয়াতি’ হিসেবেই সম্বোধন করা হলেও জারিগানের নৃত্য পরিবেশনায় যিনি থাকেন তাকে ‘জারিয়াল’ আবার কখনো ‘খেলোয়ার’ নামে ডাকা হয়। নৃত্য পরিচালনার জন্য একজন রেফারির দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বাঁশিতে ফু দেয়ার উপর নৃত্যের গতি পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
পোশাকের ব্যবহার: জারিগান পরিবেশনের জন্য শিল্পীগণ সাধারণত লাল-সবুজের কাপড় ব্যবহার করে থাকেন। তবে সাদা গেঞ্জি, সাদা লুঙ্গি বা ধূতি, গলায় রুমাল ও কোমরে লাল বন্ধনীর ব্যবহার বেশ লক্ষ করা যায়।
বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার: জারিগানে সাধারণত বেহালা, দোতারা ও বাংলা ঢোলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এছাড়াও মূল গায়েন বা বয়াতি পায়ে ঘুঙুর পরিধান করে থাকেন।
বিষয় বৈচিত্র্য: জারিগানের আঙ্গিক ও বিষয়গত বৈচিত্র্যের কারণে ভিন্নতা লক্ষণীয়। “জারিগানের বিষয়বস্তুর স্বাতন্ত্র্য বিচার করে এর কয়েকটি শেণীকরণ করা যায়-
১. ধর্মীয় ইতিহাস ভিত্তিক জারি, ২. কারবালার মর্সিয় নিয়ে বিভিন্ন ঘটনাকেদ্রিক, ৩. সামাজিক সংস্কার বিষয়ক, ৪. গণচেতনা ও রাজনৈতিক আন্দোলন ভিত্তিক, ৫. শাস্ত্র ও মতবাদভিত্তিক বিবর্তনমূলক, ৬. মনীষীদের জীবনী ভিত্তিক, ৭. প্রেম, উপাখ্যান ও পৌরাণিক চরিত্র ভিত্তিক জারি ইত্যাদি”।১
সুরবৈচিত্র্য: জারিগানের সুরে বিভিন্ন আঞ্চলিক বা লোকসুরের প্রভাব রয়েছে। “জারিগানে প্রধানত পুঁথি পড়ার সুর, রাখালী সুর এমনকি রামায়ণ গানের সুরের মিশ্রণ লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ জারিগান পয়ার ছন্দে বিলম্বিত মধ্য ও দ্রুত লয়ে গ্রাম্যশিল্পীদের মাধ্যমে এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে।২
জারিগানের শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা: জারিগানের বর্তমান অবস্থা খুব একটা গতিশীল না হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জারিগানের ঐতিহ্য এখনো নিজস্ব স্বকীয়তায় দীপ্তি ছড়াচ্ছে। “প্রতিবছর বিভিন্ন অঞ্চলে জারি ভক্তদের অন্তরাত্মার ক্রন্দন জাগাতে সক্ষম হয়”।৩
তথ্যকণিকা
১. ইসরাফিল শাহীন (সম্পা.), পরিবেশন শিল্পকলা (জারিগান: সাইম রানা), খন্ড ১২, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ৭১
২. শাহীন প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬
৩. সাইমন জাকারিয়া, বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৩৬৬
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/