শংকর মৈত্র
প্রধানবিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে কে কখন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন? মিডিয়ায় এমন খবর প্রকাশিত হয়েছে, রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন আর কীভাবে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তা খোলাসা করেননি। এটা নিয়ে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে আইন ও বিচারাঙ্গনে।
বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ সত্যি সত্যি নজির স্থাপন করেছেন। তিনিই একমাত্র ভাগ্যবান বিচারক, যিনি আপিল বিভাগে বিচারক না হয়েও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে যেখানে চারবার শপথ নিতে হয়, সেখানে তিনি শপথ নিয়েছেন তিনবার।
প্রথমবার হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে এবং দ্বিতীয়বার দুই বছর পর স্থায়ী বিচারক হয়ে আর শেষবার সরাসরি প্রধান বিচারপতি হয়ে। সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে শপথ নিতে হয়। এরপর স্থায়ী বিচারক হিসেবে শপথ নিতে হয় আর আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলে আবার শপথ নিতে হয়। সব ক্ষেত্রেই প্রধান বিচারপতি তাদের শপথ পড়ান। কিন্তু প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হলে তাকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি।
যদিও সংবিধানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পথ উন্মুক্ত। সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি 'নিযুক্ত' করেন কিন্তু অন্যান্য বিচারককে রাষ্ট্রপতি 'নিয়োগ' দান করেন। নিযুক্ত আর নিয়োগের মধ্যে সম্ভবত অর্থগত তফাৎ আছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি উপযুক্ত মনে করলে যে কাউকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করতে পারেন। হাইকোর্ট থেকে, না আপিল বিভাগ থেকে, না আদালতের বাইরে থেকে কাউকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন, সেটা রাষ্ট্রপতির বিষয়। যেমন এবার প্রথা ভেঙ্গে হাইকোর্ট থেকে সরাসরি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি।
আরেকটা বিষয় পরিস্কার হওয়া দরকার। সংবিধান প্রধান বিচারপতিকেই 'বিচারপতি' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্য সব অর্থাৎ আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের 'বিচারক' বলা হয়েছে। কোথাও বিচারপতি বলা হয়নি। কিন্তু তারা কেন বিচারপতি লেখেন, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। সংবিধানে ইংরেজি বাংলা দু'ক্ষত্রেই এটা স্পষ্ট করা হয়েছে। বাংলায় প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যদের 'বিচারক' আর ইংরেজিতে বলা হয়েছে 'জাজ' (Judge), কোথাও 'জাস্টিস' (Justice) বলা হয়নি। শুধু প্রধান বিচারপতিকে 'Chief Justice' বলা হয়েছে।
তর্কিত বিষয়টা মীমাংসা হওয়া দরকার। এ জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতের সব বিচারককেই বিচারক হিসেবে উল্লেখ করেছে। কোনো বৈষম্যের সৃষ্টি করেনি। শুধু বিচারিক ক্ষমতা ভাগ করা আছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে সৈয়দ রেফাত আহমেদই একমাত্র বিচারক, যিনি হাইকোর্ট থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন এবং আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে তিনি কোনো শপথ নেননি।
কেমব্রিজে পড়াশোনা করা প্রধান বিচারপতি যদি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, তাহলে এটা সত্যি নজিরবিহীন ঘটনা হবে। কারণ অতীতে দেশের কোনো প্রধান বিচারপতি এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, এমন নজির নেই বলে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
প্রধান বিচারপতিকে ধন্যবাদ দুটি নজির স্থাপনের জন্য। প্রথমটি হাইকোর্ট থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হওয়া আর দ্বিতীয়টি রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া।
আরো একটা নজির অবশ্য সৃষ্টি হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার (১৪ই আগস্ট) প্রধান বিচারপতির বাসভবনে গিয়ে দেখা করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত। সিনিয়র আইনজীবী, বিচারকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এমন নজির অতীতে দেখাতে পারেননি কেউ। বিদেশি দূতের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কি কাজ?
তার কোনো কাজ থাকলে যাবেন আইন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ঘরে কেন? তাদের মধ্যে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের জনসংযোগ দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে বিদেশি দূতের দেখা করে গিয়ে বলতে হবে কেন? এই 'কেন'র কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
লেখক: সাংবাদিক।
খবরটি শেয়ার করুন