জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়–সম্পর্কিত সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আজ মঙ্গলবার (২৮শে অক্টোবর) দুপুরে ড. ইউনূসের হাতে এই সুপারিশ তুলে দেন। মুহাম্মদ ইউনূস ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি।
টকশো ‘তৃতীয় মাত্রা’র উপস্থাপক, পরিচালক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান মনে করেন, দেশের ভবিষ্যতের পথে এখন সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো জুলাই সনদ। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রক্তঝরা পটভূমি থেকে উদ্ভূত এই সনদ যেন নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর মানচিত্র। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও নোবেলজয়ী ড. ইউনূস এটিকে ‘বর্বরতা থেকে সভ্যতায় উত্তরণের দলিল’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তব রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে বড় ফাঁক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তার মতে, মূল উদ্বেগটা হচ্ছে জনআস্থার। ৯ মাসের মধ্যে সনদের সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যদি সংসদ ব্যর্থ হয়, তার পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে কমিশন এখনো কোনো স্পষ্ট উত্তর দেয়নি। ফলে, গণভোটে সাংবিধানিক আদেশ অনুমোদিত হলেও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে।
নিজের ইউটিউব চ্যানেলে জিল্লুর রহমান এসব কথা বলেন। গতকাল সোমবার (২৭শে অক্টোবর) ‘ইউনূসের সংস্কার ও জুলাই সনদ কেবলই ভাঁওতাবাজি’ শিরোনামে ভিডিওটি আপলোড করা হয়েছে। আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ভিডিওটি দেখা হয়েছে ২৮ হাজারের বেশি বার, এ সময়ের মধ্যে এতে মন্তব্য এসেছে ১৬৩টি।
জুলাই সনদকে প্রধান উপদেষ্টা ‘বর্বরতা থেকে সভ্যতায় উত্তরণ’ হিসেবে যে অভিহিত করেছেন, এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তার প্রশ্ন, ‘তিনি যদি বর্বরতার সময়কাল নির্দিষ্ট করতেন, যেমন শেষ শাসনকাল, তাহলে তার বক্তব্যের অর্থ স্পষ্ট হতো।’
তিনি বলেন, ‘এখন যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে মনে হতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরই বর্বরতার মধ্যে কেটেছে। কোনো গর্বিত বাংলাদেশি কি এটি মেনে নিতে পারবে? আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও পুরো সময়কালের সাক্ষী হিসেবে এমন নিন্দা মেনে নিতে পারি না। এটি আমাদের কেমন মানুষ হিসেবে দেখায়? বিশ্বে আমাদের সম্পর্কে কী ধারণা তৈরি করে? হ্যাঁ, আমাদের কিছু ব্যর্থতা আছে, কিন্তু আমরা কি সত্যিই বর্বর ছিলাম?’
নিজের ভিডিওতে জিল্লুর রহমান বলেন, জুলাই সনদের দুটি কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক প্রশ্ন হলো—সংবিধান সংস্কার কবে এবং কীভাবে হবে। কমিশন যে কাঠামোতে এগোচ্ছে, তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদই সংবিধান সংস্কার পরিষদের ভূমিকা পালন করবে। ৯ মাসের মধ্যে সনদের সংস্কার বাস্তবায়নের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যদি সংসদ ব্যর্থ হয়, তার পরিণতি কী হবে, সে বিষয়ে কমিশন এখনো কোনো স্পষ্ট উত্তর দেয়নি। ফলে, গণভোটে সাংবিধানিক আদেশ অনুমোদিত হলেও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে।
জিল্লুর রহমান আরো বলেন, বিশেষজ্ঞরা নির্দেশনামূলক বাস্তবায়ন চান, অর্থাৎ কমিশনের ইচ্ছা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। তবে উপায় এখনো অনিশ্চিত। আলোচিত তিনটি বিকল্প— ১. নয় মাস মাস ব্যর্থ হলে সংসদ বিলুপ্ত ও নতুন নির্বাচন, যা নতুন সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংকট ডেকে আনতে পারে; ২. সময়সীমা অতিক্রান্তে স্বয়ংক্রিয় সংবিধান সংশোধন, যা গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ সনদ কোনো সাধারণ বিল নয়; পরিষদের বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত জরুরি; ৩. নির্বাচনের পর আগে পরিষদ, তারপর সংসদ, যা রাজনৈতিকভাবে অনির্দিষ্ট। ফলে বাস্তবে কমিশন সম্ভবত নির্দেশনামূলক পথ অনুসরণ করবে, অর্থাৎ সইকারী দলগুলো ক্ষমতায় এলে তা বাস্তবায়ন করবে—এটাই জুলাই সনদের বাস্তবিক ভিত্তি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে মূল উদ্বেগটা হচ্ছে জনআস্থার। যে সনদ প্রায় ১ হাজার শহীদের রক্তের ঋণে জন্ম নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন কি আসার উপর নির্ভর করবে? নাকি নাগরিকের হাতে একটি কার্যকর বাধ্যতামূলক কাঠামো তুলে দেওয়া উচিত ছিল। গণভোট যদি শুধু মতামতের প্রতীক হয়, পালনের নিশ্চয়তা ছাড়া তাহলে এটি কেবল একটি রাজনৈতিক শো হয়ে দাঁড়ায়। জুলাই সনদের আরেকটি রাজনৈতিক জট হলো বিএনপি ও সমমাননা দলের নোট অফ ডিসেন্ট।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে তাদের আপত্তি রয়েছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে—গণভোটে জনগণ সম্পূর্ণ সনদ অনুমোদন করবে নাকি বিবাদমান অংশ বাদ হবে? যখন আপসের রাজনীতি প্রধান, নোট অফ ডিসেন্টের টানাপোড়েন প্রায় পুরো প্রক্রিয়াকেই স্থগিত করতে পারে।’
জিল্লুর রহমান বলেন, ‘জুলাই সনদ কি আদতে সেই জুলাই রক্তঝরা আন্দোলনের দাবি পূরণ করেছে? লাল জুলাই-এর মূল চাহিদা ছিল বৈষম্য দূর করা। কিন্তু ৮৪টি সুপারিশের মধ্যে কৃষি, ভূমি, বাজার, শ্রমিক অধিকার, নারীর অংশগ্রহণ, তরুণদের চাকরি ও দক্ষতা উন্নয়নের প্রস্তাব প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জলবায়ু সংকট—দেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলো অবহেলিত।’
তিনি উল্লেখ করেন, অধ্যাপক ইউনূসের বিখ্যাত ‘থ্রি জিরো’ নীতির প্রতিফলনও এই ঐতিহাসিক দলিলে নেই। আরো বড় সমস্যা হলো নারী অংশগ্রহণের অভাব এবং কমিশনের গঠিত ১১টি কমিটির মধ্যে মাত্র পাঁচটির সুপারিশ রাজনৈতিক দলের কাছে গেছে। পুলিশ সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও ২০২৪ সালের সহিংসতার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কেন্দ্রীয় ছিল।
জিল্লুর রহমান বলেন, অবিলম্বে ৪০টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা উচিত, যেগুলো প্রশাসনিক আদেশেই কার্যকর করা সম্ভব। জুলাই সনদের সঠিক স্নায়ু হলো কর্ম, কথা নয়।
জামাতে ইসলামী প্রসঙ্গে জিল্লুর রহমান বলেন, জামায়াতের ক্ষমা চাওয়া ইতিবাচক রাজনৈতিক আচরণ নয়, যদি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও হত্যাকাণ্ড উপেক্ষা করা হয়। গণতন্ত্রে শুধু ক্ষমা চাইলেই ইতিহাস শুদ্ধ হয় না; পরিবর্তন আসে কর্ম ও নীতির ধারাবাহিকতায়।
তিনি সতর্ক করে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈষম্য হ্রাস, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী ও তরুণ নেতৃত্ব নিশ্চিত করা, জলবায়ু নিরাপত্তা—এই চারটি স্তম্ভ হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের মেরুদণ্ড। ইতিহাস আমাদের হাতে আগুন তুলে দিয়েছে; প্রশ্ন হলো আমরা কি সেই আগুন দিয়ে আলোকিত পথ তৈরি করব নাকি আবারো নিজেদের হাত জ্বালাব। এই মুহূর্তের নাম, দায়বদ্ধতা।
খবরটি শেয়ার করুন