ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনার গত সরকারের আমলে নেওয়া যে কোনো কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাইতেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। কখনো কখনো এ বিষয়ে অযৌক্তিক ভাষ্য সাজিয়ে তখন প্রচার-প্রচারণা চালাতেন সংবাদমাধ্যমে। সাবেক সরকারের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন রাখঢাক ছাড়াই।
এসব কারণে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাবেক সরকারের সুনজরে ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার সবশেষ ও সবচেয়ে অসফল, বিতর্কিত চীন সফর নিয়েও প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন সাবেক এই কূটনীতিক।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৮ই থেকে ১০ই জুলাই চীন সফর করেন। তিন দিনের এ সফরে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, কূটনীতিতে ভারত-চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও সম্পর্কের ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
ওই সফরের পরের মাসের ৫ তারিখে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার। হুমায়ুন কবিরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সত্য হয়নি। এতে তার কোনো 'অনুশোচনা' নেই। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাতারাতিই বদলে গেছেন তিনি। ৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে 'বিপ্লব ও দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে' সমর্থন জানান তিনি।
ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে রাতারাতি ভোল পাল্টিয়ে নতুন ভাষ্য নিয়ে হাজির হন হুমায়ুন কবির। শুরু করেন শেখ হাসিনার নিন্দা-মন্দ বলা।
ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনার বক্তব্য-বিবৃতি ও বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেওয়াকে তিনি অভিহিত করছেন, ভারত শেখ হাসিনাকে ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে তার মুখে গঠনমূলক কোনো সমালোচনাও নেই। শুধুই প্রশংসা ছড়াচ্ছেন তিনি।
হঠাৎ করে হুমায়ুন কবির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রশংসায় গদগদকণ্ঠে ভিন্ন কথা বলছেন। তার মতে, 'খালেদা জিয়ার প্রতীকী উপস্থিতিও আমাদের শক্তির উৎস হতে পারে'। এভাবে দেশে প্রতিবার সরকার বদলের সঙ্গে বদলে যায় তার ভাষ্যসহ মত, পথ ও রাজনৈতিক অবস্থান। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের পক্ষে ভাষ্য তৈরি করেন।
বিএনপি এখন ক্ষমতায় না থাকলেও দলটির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে। যদিও তা দিনেদিনে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। হুমায়ুন কবির বলছেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে আজ বাংলাদেশের সব শ্রেণি, পেশা ও মতের মানুষ ওনার (খালেদা জিয়া) জন্য দোয়া করছেন। একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? তিনি সেটা অর্জন করেছেন নিজের যোগ্যতা, মেধা ও ব্যক্তিগত গুণাবলির মাধ্যমে।'
তিনি বলেন, অনেক প্রতিকূলতা, অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) গেছেন; রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হিসেবে বহু দায়িত্ব পালন করেছেন। মানুষের ভালোবাসা কখনো শুধু পদ দিয়ে আসে না, এটা আসে ব্যক্তিগত গুণ ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে।
তিনি বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কয়েকবার কাছাকাছি গিয়ে আলাপের যে সুযোগ পেয়েছি, সেখানে দেখেছি তিনি (খালেদা জিয়া) সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন, শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন, যুক্তিগ্রাহ্য কথা গ্রহণ করেছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এ ধরনের স্বস্তি পাওয়া সত্যিই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা।
দৈনিক বণিক বার্তায় এক মন্তব্য কলামে হুমায়ুন কবির এসব কথা বলেন। পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণ তার লেখাটি আজ মঙ্গলবার (২রা ডিসেম্বর) প্রকাশিত হয়েছে 'খালেদা জিয়ার প্রতীকী উপস্থিতিও আমাদের শক্তির উৎস হতে পারে' শিরোনামে।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০০১-০৬ সময়ে যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন দুইবার সরাসরি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং কথাবার্তা বলার সুযোগ হয় হুমায়ুন কবিরের। সেই অভিজ্ঞতাও লেখাটিতে তুলে ধরেন তিনি।
তিনি লেখেন, 'জাতির এ সংকটলগ্নে ওনার (খালেদা জিয়া) মতো একজন নেতৃত্বের প্রতীকী উপস্থিতিও আমাদের জন্য শক্তির উৎস হতে পারে বলেই মনে করি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং আমরা যে ক্রান্তিকাল পার করছি, সে সময় তিনি যেন আমাদের সঙ্গে থেকে দেশের উত্তরণের পথচলায় অবদান রাখতে পারেন। এটাই আমার প্রত্যাশা।'
প্রসঙ্গত, ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ১০ দিন ধরে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। গত ২৩শে নভেম্বর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসকেরা জানান, খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এরপর চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ই তার অবস্থা খারাপ হয়।
এমন পরিস্থিতিতে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবিরের তাকে নিয়ে লেখাটিকে গণতান্ত্রিক সমাজে স্বাভাবিক সৌজন্যতাবোধ হিসেবে দেখা যায়। তবে নানা শ্রেণি-পেশার নেটিজেনের এ প্রসঙ্গে বক্তব্য ভিন্ন।
তার লেখার লিংক শেয়ার করে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনেরা বলছেন, দেশে কথিত গণতন্ত্রের চর্চার কথা সব সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়। কোনো সরকারই সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করেনি।
শেখ হাসিনার একটানা সাড়ে পনেরো বছরের সরকারের আমলে খালেদা জিয়া ও বিএনপি নানা অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড ও নিপীড়নের শিকার হলেও হুমায়ুন কবির তখন সরকারের বিরুদ্ধে টুঁশব্দটিও করেননি। বিএনপির সরকার গঠনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি খালেদা জিয়াকে নিয়ে এখন ইতিবাচক মূল্যায়ন করছেন।
এম হুমায়ুন কবির পতিত স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারের আমলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম ও দ্বিতীয় সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখনও তার বক্তব্যে সুবিধাভোগী আমলার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠত। এরশাদের সরকারের প্রশংসায় গদগদ করতেন।
নব্বইয়ের দশকের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের সরকারের পতন হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমবারের মতো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। হুমায়ুন কবির তখন কূটনীতিক হিসেবে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার আশায় বিএনপির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন।
খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে নিয়োগ পান জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে, যা রাষ্ট্রদূত মর্যাদার পদ। আশির দশকের শুরুতে, ১৯৮১ ব্যাচের পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে (সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন) কর্মজীবন শুরু করা হুমায়ুন কবির ২০১০ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সচিব পদে অবসর নেন।
পুরো কর্মজীবনে জিয়াউর রহমানের সরকার থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার সরকার, এর মধ্যে যত সরকার এসেছে, সব সরকারে 'নিজেদের লোক' হিসেবে মিশে গিয়ে সুবিধা নিয়েছেন তিনি। একই অঙ্গে তার এত রূপ!
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের দুটি সরকার দেখেছেন সাবেক এই কূটনীতিক। দুই সরকারের আমলে তিনি দুই সরকারেরই 'গুণমুগ্ধ শুভাকাঙ্খী'। এক এগারোর জরুরি অবস্থার তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি সংস্কারপন্থীর রূপ ধারণ করেছিলেন।
ওই সরকারের আমলেই ২০০৭ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে কাজ করেন তিনি।
বিএনপির পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিতর্কমুক্ত নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরে ২১ বছর পর। হুমায়ুন কবির তখন কেবলা বদল করে আওয়ামী লীগমুখী হয়ে পড়েন। সুবিধা ভোগের আশায় সরকারের প্রশংসাগীতি গাইতে শুরু করেন।
১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে দায়িত্ব পালনের সুযোগ আদায় করেন। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে চারদলের জোট সরকার গঠিত হলে হুমায়ুন কবির আওয়ামী লীগের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন বিএনপি-জামায়াতের দিকে। চারদলের জোট সরকার থেকেও পদোন্নতি ভাগিয়ে নিতে তদ্বির শুরু করেন। সফলও হন।
অতীতে যখন যে সরকার ছিল, তখন তার হওয়ার ভান ধরা হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ যায় ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে। খালেদা জিয়া সেসব অভিযোগকে গুরুত্ব দেননি। তাকে ২০০৩ সালে নেপালের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয় তার সরকার। হুমায়ুন কবির তখন ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল।
এর আগে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে কাঠমান্ডুতে সার্ক সামিটের সময় তাকে সাময়িকভাবে কাঠমান্ডু মিশনের প্রধান করে পাঠানো হয়েছিল সার্ক সামিট আয়োজনের জন্য। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সার্ক সম্মেলনে অংশ নেন খালেদা জিয়া।
হুমায়ুন কবির বর্তমানে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
খবরটি শেয়ার করুন