ফাইল ছবি (সংগৃহীত)
বাউল কুলের শিরোমনি ফকির লালনের ভাষাজ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর। তিনি গানের বাণীতে যে সকল শব্দের ব্যবহার করেছেন তার গভীরতা অসীম। শব্দ চয়নে মহাত্মা ফকির লালন দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন গানে ‘গৌর’ শব্দটির ব্যবহার করেছেন যার প্রজ্ঞাময় ব্যাখ্যা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
গৌর শব্দটি দ্বারা ফকির লালন সাধনা মার্গের সিদ্ধপুরুষকে, কখনো কখনো রসপূর্ণ সত্তাকে বুঝিয়েছেন। অনেক লালন গবেষকের মতে, গুড়ের মিষ্টতা থেকেই গৌড় বা গৌর শব্দটি এসেছে।
আবার লালন গানের একাংশে বলেছেন, “গৌর কি আইন আনিলেন নদীয়ায়”। গানের এ বাণীর মর্মকথা হলো শ্রীচৈতন্য নদীয়াবাসীর জন্য এমন এক সাধনার দ্বার উন্মোচন করলেন যেখানে জীব সত্তাকে একাধারে জীবন্ত সত্তা রূপে বিন্দুধ্যানের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক লীলাচক্রে অবস্থানের সাধনার কথা বলা হয়েছে।
আরেক জায়গায় লালন বলেছেন গৌর চাঁদ শ্যামচাঁদেরই আভা সৃষ্টিকারী রূপে বিরাজমান। যেভাবে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের শ্যামভাব নানা ধারা উপধারায় শ্রীচৈতন্যের নিকট ভাবের পূর্ণ রসের সঞ্চার ঘটায়। এটাকেই মূলত গৌর চাঁদের মধ্যেই শ্যাম চাঁদের আভা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
আবার মহাত্মা লালন ‘গৌর চাঁদের হাট’ দ্বারা পরিপক্ক পূর্ণবিন্দুর বাজার বা রস আস্বাদনের পরিপূর্ণতাকে বুঝিয়েছেন। এছাড়া এই দেহের রস যখন বায়ুক্রিয়ার মধ্যদিয়ে মণিমূল বেয়ে পূর্ণ শক্তিতে উর্ধ্বমুখী চাপ সৃষ্টি করে তখন যে ভরা জোয়ারের সঞ্চার ঘটে তা আবার রস শূন্য অবস্থায় নিম্নমুখী করণের প্রক্রিয়াই হলো ‘গৌর প্রেমের এমনই ল্যাটা, আসতে জোয়ার যেতে ভাটা’।
মহাত্মা লালন বেশ কিছু গানে ‘গৌরাঙ্গ’ শব্দটির উল্লেখ করেছেন। আসলে রাধার অন্তরে কৃষ্ণ আর বাহিরে রাধার স্বীয় মূর্তি ছিল। আর এটাই শ্রীচৈতন্যের গৌরাঙ্গ (গৌর+অঙ্গ) রূপ। শ্যামভাবে বিরাজমান বৃন্দাবনের কৃষ্ণ নদীয়ায় এসে গৌরবর্ণ ধারণ করে হয়েছেন রসে উত্তীর্ণ। আর এদিকে নিত্যলীলা শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভের পাশাপাশি শ্রীকৃষ্ণ নবরসে পেয়েছেন পরিপূর্ণতা।
আরো পড়ুন : পঞ্চগড় জেলার লোকউৎসব ও লোকাচার
বাউল শিরোমণি মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির গানের দর্শন বুঝতে গেলে আগে লালনভাষা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অতীব জরুরী। কেননা, লালনের গানের এক একটি শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে গভীর তত্ত্বজ্ঞান।
তথ্যসূত্র
১. আবদেল মান্নান, লালনভাষা অনুসন্ধান, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৯
২. আবদেল মান্নান, লালনদর্শন, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৯
৩. আবুল আহসান চৌধুরী (সম্পা.), শ্রীবস্তকুমার পাল, মহাত্মা ফকির লালন, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা, ২০১১
৪. মোহাম্মদ আবদুল করিম মিঞা, বাউল লালন পরিভাষা, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০০
এস/ আই.কে.জে/