ছবি : সংগৃহীত
রবিউল হক
দেশের অন্যান্য জেলার মতো পঞ্চগড় জেলাতেও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পালিত হয়ে আসছে বিভিন্ন উৎসব। লোকউৎসব সমাজের নানা বিশ্বাস-সংস্কারের মধ্যে নিহিত, আচার-অনুষ্ঠানে সংহত, নানা পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে উৎসারিত। লোকউৎসব সমাজের মানুষের কল্যাণে সুদীর্ঘকাল হতে বহমান। এসব উৎসব ও আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে নববর্ষ বা বৈশাখী উৎসব, নবান্ন, ঈদ উৎসব, মহররম, চড়ক উৎসব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ লোকাচার। লোকাচার হচ্ছে যুগ হতে যুগান্তরে, কাল হতে কালান্তরে প্রচলিত সমাজের মানুষের সমন্বিত চিন্তার ফসল। এদেশের লৌকিক আচার অনুসারে কাব্যবস্তু এবং অতিন্দ্রীয় শক্তির প্রতীকের উপস্থিতি ছাড়া সঠিকভাবে তা পালিত হয় না। এছাড়াও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ধান ও দূর্বাকে ঐশ্বর্য ও দীর্ঘ জীবনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালায় শাস্ত্রীয় বা ধর্মীয় সংস্কারভিত্তিক ও লৌকিক এ দুই ধরনের লোকাচারের কথা বলা হয়েছে। লৌকিক লোকাচার ও ধর্মীয় সংস্কারভিত্তিক লোকাচারে শুধু পার্থিব বা অপার্থিব কামনাই নয় বরং প্রাত্যহিক জীবনে আরোগ্য কামনা, অভাব-অনটন হতে মুক্তি, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, বৃষ্টির আবাহন, দুষ্টের বিনাশ ও পারিবারিক শান্তি কামনায় পালিত হয়ে আসছে।
আরো পড়ুন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি কারো দানের জমিতে প্রতিষ্ঠিত? জানতে হলে পড়তে হবে
পঞ্চড় জেলায় প্রচলিত লোকাচারের মধ্যে গর্ভবতী মায়েদের সাত খাওয়ানো (সাত প্রকারের মিষ্টান্ন), শিশুদের মুখে ভাত ও অন্নপ্রাশন, নাম রাখা ও আকিকা পালনের রীতি বেশ প্রচলিত। এ অঞ্চলে বিবাহ সংক্রান্ত বিভিন্ন লোকাচারের মধ্যে পান-চিনি, গায়ে হলুদ, থুবরা কৌটা, বর স্নান, অধিবাস, আগ বারানি, বধূবরণ, কড়ি খেলা, আংটি খেলা, খইঞ্চা খাওয়া, বাসি গোসল, বৌভাত, আঠরা, কইন্যা পাত্রের পত্র ফিরানি প্রভৃতি বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও পঞ্চগড় জেলার কোচ বা পলিয়া সমাজে বাল্যবিবাহ রীতিকে বলা হয় গৌরীদান। অপরদিকে এ জেলার তেতুলিয়ায় বসবাসকারী সাঁওতালদের বিয়ের দিন পাঁচটি কলাগাছ মাটির উঁচু বেদির মধ্যে পুঁতে রাখার যে রীতি প্রচলিত তাকে স্থানীয় ভাষায় ‘মারোয়া’ নামে অভিহিত কারা হয়ে থাকে। মৃতব্যক্তি সম্পর্কিত হিন্দু আচারের মধ্যে অশৌচ পালন, হবিষ্যান্ন গ্রহণ এবং তিন ধরনের শ্রাদ্ধ লক্ষ করা যায়। গবাদি পশু সংক্রান্ত লোকাচারের মধ্যে এ জেলায় পালিত হয়ে আসছে গরু বরণের রেওয়াজ, গরুর মঙ্গল কামনা, গরু চুমা, গাছের বিবাহরীতি, উকিল বাপ, ধরম বাপ দায় নামক এরূপ নানা লোকাচার পালনের রীতি বহুল প্রচলিত। এ অঞ্চলে বট-পাকুড়ীর বিবাহরীতি বেশ জনপ্রিয়। নানা ঐতিহ্যবাহী সংস্কার পালনের মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন অতিবাহিত।
সূত্র:
১. মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত, অনার্য, ঢাকা, ২০১১
২. মাযহারুল ইসলাম তরু, চাপাইনবাবগঞ্জের লোকসংস্কৃতির পরিচিতি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯৯
৩. শামসুজ্জামান খান, (সম্পা.), বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৩
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
এস/ আই.কে.জে/