বৃহস্পতিবার, ২৩শে অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ই কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** সরকারে থাকা ‘দলীয় উপদেষ্টা’ আসলে কারা *** জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নভেম্বরে গণভোটের দাবি জামায়াতের *** পুলিশের বলা ‘ত্রিভুজ প্রেমের গল্প’ নিয়ে প্রশ্ন জোবায়েদের শিক্ষকের *** দেশের সব ভূমি অফিসে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ *** ‘উপদেষ্টা পরিষদে শুদ্ধি অভিযান জরুরি’ *** বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা পেলেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর: নাহিদ *** শুক্র ও শনিবার বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম পুরোদমে চলবে *** সেন্ট মার্টিন নিয়ে ১২ নির্দেশনা সরকারের, প্রজ্ঞাপন জারি *** সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের রাতযাপন নিয়ে মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা *** ‘অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত উপদেষ্টাদের জেলে যেতে হতে পারে’

‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলায় ভারতে মুসলিমদের সঙ্গে যা ঘটছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৫:৪৭ অপরাহ্ন, ২২শে অক্টোবর ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের উত্তর প্রদেশের শিল্পনগরী কানপুরের একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আলোকসজ্জা করা একটি সাইনবোর্ড টাঙানো হয়।

সাইনবোর্ডে লেখা ছিল: ‘আই লাভ মুহাম্মদ’। অর্থাৎ আমি মহানবী মুহাম্মদকে (সা.)-কে ভালোবাসি। সাইনবোর্ডে লাল রঙের একটি হার্ট চিহ্নও আঁকা ছিল।

কানপুরের সাঈদ নগরের শ্রমজীবী বাসিন্দারা বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মতোই মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন করছিলেন। এতে সাজসজ্জার অংশ হিসেবে তারা ওই সাইনবোর্ড টাঙান।

দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ মিলাদুন্নবী (সা.)–এ ধর্মীয় সমাবেশ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত এবং মহানবীর জীবন ও শিক্ষার ওপর আলোচনার আয়োজন করে। কিছু স্থানে শোভাযাত্রা হয়। তবে ভারতের কানপুরে এ ধরনের সাইনবোর্ড টাঙানোর ঘটনা আগে ঘটেনি বলে জানা যায়।

সাঈদ নগরে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা সাইনবোর্ডে আলো জ্বলে ওঠার পর কয়েকজন হিন্দু ব্যক্তি সেখানে গিয়ে এর বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন। পুলিশ ডাকা হয় এবং কয়েক ঘণ্টা বিশৃঙ্খলার পর সেই রাতেই সাইনবোর্ডটি সরিয়ে দেওয়া হয়। খবর আল জাজিরার।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে সাঈদ নগরের নয়জন মুসলিম পুরুষ ও অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলায় এ পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি।

সাঈদ নগরের বাসিন্দা মোহিত বাজপায়ী শ্রী রামনবমী সমিতি নামের একটি হিন্দু গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা নিয়ে আপত্তি নেই। কিন্তু সাইনবোর্ডটি যে স্থানে রাখা হয়েছিল, তা নিয়ে আপত্তি আছে। কারণ, ওই স্থানটি হিন্দুদের একটি উৎসবের জন্য ব্যবহার করা হয়।

মোহিত বাজপায়ী আল-জাজিরাকে বলেন, ‘সংবিধানে সব ধর্মের সমান অধিকার আছে। তবে সাইনবোর্ডটি যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখানে সাধারণত আমাদের রাম নবমীর সাজসজ্জা করা হয়। সবারই নিজ নিজ ধর্মচর্চা করার অধিকার আছে। তবে নতুন জায়গায় নতুন প্রথা চালু করা উচিত নয়।’

তবে সাঈদ নগরের মুসলিম বাসিন্দারা বলেন, সাইনবোর্ডটি এমন এক উন্মুক্ত স্থানে রাখা হয়েছিল, যেখানে তারা প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপনের জন্য জড়ো হন।

ভারতের উত্তর প্রদেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ মুসলিমের বসবাস, যা সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশই মুসলিম। ২০১৭ সাল থেকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশটি শাসন করছেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথ। উগ্রবাদী এই নেতা মুসলিমবিরোধী বক্তব্য ও নীতির জন্য পরিচিত। তিনি নরেন্দ্র মোদির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির একজন প্রভাবশালী নেতা।

মুসলিম গোষ্ঠী ইত্তেহাদ-ই-মিল্লাত কাউন্সিলের (আইএমসি) প্রধান ও বেরলভি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আহমেদ রেজা খানের উত্তরসূরি মাওলানা তৌকির রেজা খান গত ২১শে সেপ্টেম্বর বেরেলি ও কানপুরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে একটি মাঠে জড়ো হতে সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন সমাবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ২৫শে সেপ্টেম্বর আইএমসি একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। এতে মানুষজনকে বিক্ষোভের জন্য জড়ো না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তবে এর কয়েক ঘণ্টা পর তৌকির রেজা খানের সমর্থকেরা নিজেদের মধ্যে বার্তা চালাচালি করতে শুরু করেন এবং দাবি করেন, আইএমসির ওই বিবৃতিটি ভুয়া। আইএমসিকে কলঙ্কিত করার জন্যই এটি করা হয়েছে।

পরদিন জুমার নামাজের পর হাজার হাজার মুসলিম বেরেলির একটি প্রখ্যাত মাজারের আশপাশে জড়ো হন। তাদের হাতে ছিল ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ লেখা পোস্টার। এ সময় তারা কানপুরে পুলিশি ভূমিকার বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।

স্থানীয় প্রশাসনের অভিযোগ, এ সমাবেশের অনুমতি ছিল না। সমাবেশ থেকে কিছু মানুষ পুলিশের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে এবং সরকারি স্থাপনা ভাঙচুর করে। পুলিশ তদের লাঠিপেটা করে এবং তৌকির রেজা খানসহ কয়েক ডজন মুসলিমকে গ্রেপ্তার করে। শহরে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কানপুরের ঘটনার কয়েক দিন পরে সেখান থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দূরে উত্তর প্রদেশের আরেক শহর বেরেলিতে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। শহরটি বেরলভি সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান ঘাঁটি। বিশ্বজুড়ে এ সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ কোটি।

পরদিন উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বেরেলিতে অস্থিতিশীলতার নিন্দা জানান এবং এটিকে সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা বলে আখ্যা দেন।

এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কখনো কখনো মানুষ তাদের বাজে অভ্যাস ত্যাগ করতে পারে না। এ জন্য কখনো কখনো কঠোর হতে হয়, যা আপনারা গতকাল বেরেলিতে দেখেছেন। একজন মাওলানা ভুলে গেছেন যে কে ক্ষমতায় আছে।’ তার এই বক্তব্যের পর মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন আরও বেড়ে যায়।

উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য বিজেপিশাসিত রাজ্যে বিভিন্ন অভিযোগে মুসলিমদের বাড়ি ও ব্যবসায়িক স্থাপনা উচ্ছেদ করা এখন সাধারণ ঘটনা। যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এসব উচ্ছেদকে ‘বুলডোজার জাস্টিস’ বলে নিষিদ্ধ করেছেন।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এসব স্থাপনা উচ্ছেদ আইনবহির্ভূত। বিচারিকপ্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে অভিযুক্তদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যদিও উত্তর প্রদেশের সরকার বলেছে, বেরেলিতে উচ্ছেদ করা ভবনগুলো অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল।

প্রসিদ্ধ উর্দু কবি মুনাওয়ার রানার মেয়ে সুমাইয়া রানা আল–জাজিরাকে বলেন, ‘মুসলিমদের প্রতিবাদ করার বৈধ অধিকার দমন করতে পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। বিজেপি সরকার ভীতি সঞ্চার করতে চায়, যাতে মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় কথা বলার সাহস না পায়।’

মানবাধিকার সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর) বলেছে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‘আই লাভ মুহাম্মদ (সা.)’ সংক্রান্ত প্রচারণা কেন্দ্র করে অন্তত ২২টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে আড়াই হাজারের বেশি মানুষের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত বেরেলিতে অন্তত ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এপিসিআরের সাধারণ সম্পাদক নাদিম খান আল–জাজিরাকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ নবী (সা.)–এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে লেখা একটি স্লোগানকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করছে। এটিকে উসকানিমূলক হিসেবে বর্ণনা করছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন আইনিপ্রক্রিয়া না মেনে মামলা দায়ের এবং অভিযুক্তদের সম্পত্তি উচ্ছেদ করছে। এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে।’

আই লাভ মুহাম্মদ

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250