ছবি: সংগৃহীত
অরুন চৌধুরী
লোকসঙ্গীতের ধারা ও বিবর্তন বিষয়ে আলোচনার প্রাক্কালে আমাদের লোকসঙ্গীত কাকে বলে তা জেনে নেয়া ভালো। না হলে আলোচনার রসবোধ ব্যাহত হতে পারে।
লোকসঙ্গীতের সংজ্ঞায় আমরা যা বুঝি তা হলো- গ্রামবাংলার সমাজ জীবনে যে গান বা সঙ্গীত মুখে মুখে রচিত হয়ে মুখেই প্রচার লাভ করে তাকেই সাধারণত লোকসঙ্গীত বলে। লোকসঙ্গীতের সংজ্ঞা দেয়া এক কথায় কঠিন। তবে ভাব, চিত্র, কাহিনী অবলম্বনে ছন্দময় সুরাশ্রিত রচনাকে লোকসঙ্গীত বলা যায়।
লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য বা ধারা
লোকসঙ্গীত নিজেই বাংলাদেশের সঙ্গীত অঙ্গনের একটি অন্যতম ধারা। এটি বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত। এই সঙ্গীতে গ্রাম-বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা ফুটে ওঠে।
লোকসঙ্গীতের আবার অনেক ভাগ আছে যা একটি দেশের বা দেশের যেকোনো অঞ্চলের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।
বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত মূলত ৪ প্রকার। যেমন- ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, গম্ভীরা। তবে জারি-সারি, বাউল-মুর্শিদি, মারফতি, কবিগান, কীর্তন- এরকম প্রধান কয়েকটি লোকসঙ্গীতের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হলেও এর সবকটি ধারা কিন্তু এখন সমানভাবে বহমান নয়।
আবার আঞ্চলিক গান বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন-
চট্কা গান, ভাটিয়ালি, আখড়াই গান, ভাওয়াইয়া, মাদার গান, ঝুমুর, গম্ভীরা, হাপু গান, ব্যবহারিক গান, বিবাহ সম্পর্কিত, কনে সাজানিয়া গান, জল ভরার গান, কন্যা বিদায়ের গান, খেলা সম্পর্কিত, পাশা খেলার গান, শোক সঙ্গীত, বিচ্ছেদী গান, আনুষ্ঠানিক গান ছাড়াও কীর্তন, ঢপ গান, ঘেঁটু গান, জারি গান, চড়ক, পর্বের গান, পৌষ আগলানো গান, কর্ম সঙ্গীত, ছাদ পেটানোর গান, সারি গান, পটের গান ইত্যাদি।
মূলত এই সকল লোকসঙ্গীত অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে।
যেমন: গম্ভীরা: চাঁপাইনবাবগঞ্জ (বৃহত্তর রাজশাহী) অঞ্চলের গান।
জারি: ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের গান। এটি মূলত দুই পক্ষের মধ্যে গানের প্রতিযোগিতা।
গাজীর গীত: রংপুর অঞ্চলের গান।
চটকা: রংপুর অঞ্চলের গান।
ভাওয়াইয়া: রংপুর অঞ্চলের গান। গরুর গাড়ির চালকদের মুখে মুখে এ গান প্রচলিত।
সারি: নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার সময় পরিবেশিত গান।
ভাটিয়ালী: ময়মনসিংহ অঞ্চলের গান। জেলে-মাঝিদের গান হিসাবে এই গান অধিক পরিচিত।
লেটো: ময়মনসিংহ অঞ্চলের গান।
ভান্ডারি: চট্টগ্রাম অঞ্চলের গান।
পালা: সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলের গান হিসাবে সুপরিচিত।
কীর্তন: রাধাকৃষ্ণের প্রশংসাসূচক গান।
বাউল: বাউল শব্দটি বাউর শব্দ হতে এসেছে। যার অর্থ বাতুল অথবা পাগল। তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সংসার ত্যাগী মানুষ। ২০০৫ সালে UNESCO বাউল গানকে Heritage of Humanity (মানবতার ধারক) হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
লোকসঙ্গীতের বিবর্তন
সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এলাকাগত পরিবেশ এক নয় বলে লোকসঙ্গীতে আঞ্চলিক প্রভাব খুব স্পষ্ট। পশ্চিমে বাংলার লোকসঙ্গীতের মৌলিক ভিত্তি ঝুমুর, উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া, পূর্ববাংলার ভাটিয়ালি, দক্ষিণ বাংলার সারি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যে নির্ভরশীল। এছাড়া সাঁওতাল, শবর, লোধা, হাজং, মোরং, চাকমা প্রভৃতি উপজাতির সঙ্গীতও আপন বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। এই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যে থাকলেও সমগ্র বাঙালি জাতি লোকঙ্গীতের দিক থেকে একই ঐক্য সূত্রে গাঁথা।
লোকসঙ্গীত আধুনিক যে কোনো সঙ্গীতের মতোই বাণী, ও সুরের সমন্বিত রূপ। তবে এ সঙ্গীতের বাণীর ভাষা আঞ্চলিকতায় পরিপূর্ণ এবং সুরও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এটি সাধারণত একটিমাত্র ভাব বা বিষয়কে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে।
মূলত লোকসঙ্গীত নিরক্ষর লোকসমাজে লালিত হয় এবং নিরক্ষর রচয়িতা ও গায়ক গায়িকাই লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্যকে পুরুষানুক্রমে সামনের দিকে নিয়ে যায়।
লোকসঙ্গীতের একটি প্রধানতম উপাদান তার সুর। সুর বৈচিত্র্য, সঙ্গীতের চরিত্র ও কাঠামো, স্বরের রূপভেদ, ছন্দে, ধ্বনিতে ও বাচনভঙ্গিতে, আঞ্চলিকতার বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে ওঠে।
লোকসঙ্গীত আসলে কোনো প্রথাগত সঙ্গীত চর্চা নয়; এতে গায়কের মেজাজ, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত ও পরিবেশের উপর লোকগীতির গায়নরীতি অনেকটাই নির্ভর করে৷ প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন, ‘লোক সংগীতের ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা৷'
বাংলাদেশে বর্তমানে লোকসঙ্গীতকে ঘরবন্দী করে বাইরের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছে৷ ‘বাহিরানা' প্রসঙ্গে আরো বলতে হয়, এখনো গ্রাম-গ্রামান্তরে অনেক প্রতিভাবান লোকসঙ্গীত স্রষ্টা ও শিল্পী পড়ে আছে যাদেরকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে পারলে বাংলা লোকসঙ্গীতের প্রসার বাড়তে পারে৷
বর্তমান বাংলাদেশে বাউল গানই জনপ্রিয়৷ প্রায় সব বয়সের শ্রোতাই সবটা না বুঝলেও এ গান শুনে আন্দোলিত হয়৷ বাউল তো মূলত আখড়ার গান- যেখানে গুরু কিংবা সাঁইজি গানের তত্ত্বকথার ভেতর দিয়ে তাঁর শিষ্যদেরকে সাধন-ভজনের ক্রিয়া-করণ বুঝিয়ে দেন৷
তবে এ কালের বাউল শিল্পীদের তেমন গুরুদীক্ষা নেই, সাধন-ভজনেও মন নেই৷ যেনতেন প্রকারে একটা গানের বই, ক্যাসেট কিংবা সিডি বের করে বাজারে ছাড়তে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন অনেকেই৷ এভাবে বাউল গানে নানা বিকৃতি ও পরিবর্তন আসছে ৷ তা সত্ত্বেও প্রবীণ বাউল গুরু যাঁরা এখনো গান করছেন তাঁরা তাঁদের সাধনমার্গের অঙ্গ হিসেবেই তা করছেন৷ তাঁরা গুরুপরম্পরায় পাওয়া বাণী ও সুর মেনেই গান গেয়ে চলেছেন৷
আরো পড়ুন: আপনার ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগত রাখুন
তবে নতুন প্রজন্মের বাউল গায়করা রাতারাতি খ্যাতিলাভ এবং নিজেকে তারকাশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত৷ ইদানিং ব্যান্ড বা রক মিউজিক যারা করছেন তারা তাদের নিজস্ব স্টাইলে ইচ্ছেমতো সুর পরিবর্তন করে বাউল গানও গাইছেন৷ আদি বাউল গানের বিলম্বিত তাল-লয়ের বদলে দ্রুত তাল-লয় দিয়ে বেশ খানিকটা রিদমিক করে গাওয়া হচ্ছে-যাতে গানের বাণীর ব্যঞ্জনার চাইতে বড় হয়ে উঠছে দর্শক-শ্রোতাদের উত্তেজিত করা। কোনো কোনো শিল্পী বাউল গানের ফিউশনও করছেন -যা মঞ্চে এবং টেলিভিশনে প্রচারিতও হচ্ছে৷ এসব কারণে বাউল গানের আদি সুরকাঠামো ভেঙে যাচ্ছে৷
কবিগান এদেশের অন্যতম লোক গান। দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলা ছাড়া এখন বাংলাদেশে কোথাও কবিগানের আসর বসে বলে শোনা যায় না৷ কীর্তন, অষ্টক ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষঙ্গের গানগুলোও উঠে যাচ্ছে প্রায়৷ গম্ভীরায় একসময় কৃষির কথা, কৃষকের কথা থাকতো৷ নানা-নাতি কৃষক সেজে মাথায় মাথাল দিয়ে লড়ি হাতে গান করে বটে, তবে সে গান এখন প্রাধান্য পায় সরকারি প্রকল্পের প্রচারণায়৷ ৷ লোকে আসলে মজা পায় গম্ভীরা গায়ক নানা-নাতির ঠাট্টা-মশকরা বা রঙ-তামাশায়৷
এক সময় পালাগান ও বিচার গানের সমাদর ছিল ভাবুক শ্রোতাদের কাছে৷ সৃষ্টিতত্ত্ব, আদম-হাওয়া, আল্লাহ-রসুল, শরীয়ত-মারেফত, নারী-পুরুষ ইত্যাদি বিষয়ে তত্ত্বাশ্রিত বিতর্কমূলক গানের আয়োজন এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না ৷ নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের রুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে ৷ তারা এখন তত্ত্বভারাক্রান্ত বা গভীর মরমি ভাবাপন্ন গান শুনতে চায় না ৷ তারা পছন্দ করে দ্রুততালপ্রধান যৌন আবেদনময় হালকা, চটুল প্রেমের গান৷
এই সকল নেতিবাচক অবস্থার মধ্যেও লোকসঙ্গীতের চর্চা চলছে৷ আশার কথা হলো বাউল গান তার দেহতত্ত্ব ও মরমিভাবনার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হয়েছে এবং ক্রমশ তার চর্চাও বাড়ছে৷ বিশেষত মানবীয় প্রেমের আকাঙ্খা ও আকুতি ভরা যে গান, সে গানের আবেদন কখনোই ফুরাবে বলে মনে হয় না৷ কেবল তা উপযুক্ত শিল্পীর আকর্ষণীয় গায়কির ভেতর দিয়ে পরিবেশন করতে পারলেই হয়৷ বাঙালি হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা- স্বকীয় সংস্কৃতির ধারক, বহুবিচিত্র রসেভরা লোকসঙ্গীতের পুনরোজ্জীবন ঘটুক৷
এসি/ আই. কে. জে/