ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি তার লেখা নয়, এটি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারীর 'লেখা' বলে বেসরকারি টিভি চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। ১৬ই আগস্ট, শনিবারে প্রচারিত চ্যানেলটির এই প্রতিবেদন ইতোমধ্যে ভাইরাল (আলোচিত)। এই প্রতিবেদনের লিংক শেয়ার করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা চলছে। পুলিশের যে শাখা থেকে 'চাঞ্চল্যকর তথ্য' পাওয়ার ভিত্তিতে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনটি সাজানো হয়েছে, এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক নেটিজেন।
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি সংকলন করে পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) পদ পান জাবেদ পাটোয়ারী। আর সহযোগীরা পান একটি করে ফ্ল্যাট ও এক কোটি টাকা। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) নথিতে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। যা চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের হাতে এসেছে।'
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, 'এই অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখা এসবি থেকে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। একাধিক নথিতে দেখা যাচ্ছে, এই বইটি আসলে লিখেছেন সাবেক পুলিশ প্রধান জাবেদ পাটোয়ারী ও তার নেতৃত্বে ১২৩ সদস্যের একটি বিশাল দল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সান্নিধ্য এবং আনুগত্য নিশ্চিত করতে বইটি লেখেন জাবেদ পাটোয়ারী ও তার দল। এর ফলে ২০১৮ সালে জাবেদ নিয়োগ পান আইজিপি হিসেবে।'
নেটিজেনরা অভিযোগ করছেন, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনে সূত্রের বরাত থাকলেও দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য নেই। স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপনের বেলায় যেভাবে নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্য দিয়ে তা পাঠক-দর্শকের কাছে নির্ভরযোগ্য করে তুলতে হয়, প্রতিবেদনটি তেমন নয়। এটি দায়সারা গোছের ঢালাও দাবি।
সুখবর ডটকম অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়েছে, 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' যখন প্রকাশিত হয়, তখন জাবেদ পাটোয়ারী পুলিশ প্রশাসনে 'বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক কর্মকর্তা' হিসেবে কোণঠাসা ছিলেন। 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। জাভেদ পাটোয়ারী পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের আস্থাভাজন তখনও হয়ে ওঠেননি। অবশ্য আরো পরে তিনি গনঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন, একপর্যায়ে পুলিশের মহাপরিদর্শকের দায়িত্ব পান। পরে নানাভাবে বিতর্কিত হন।
অনুসন্ধান বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের পর ও মহাজোটের সরকারের পাঁচ বছর পর্যন্ত জাবেদ পাটোয়ারী 'আওয়ামী লীগ বিরোধী কর্মকর্তা' হিসেবে একধরনের কোণঠাসাই থাকেন। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের বছর দুয়েক পর তিনি শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি বই লেখাকে কেন্দ্র করেই। তবে সেই বইটির নাম 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' নয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় মহাজোট সরকারের আমলে, অর্থাৎ ২০১২ সালে।
পুলিশের বর্তমান ও সাবেক অন্তত দশজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে সুখবর ডটকম আলাপ করলে তারা জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার যেসব গোপন নথি আছে, সেগুলো বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি উদ্যোগটি নেন ২০১৬ সালের দিকে। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে ওই সময়ের পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপও করেন শেখ হাসিনা। জাবেদ পাটোয়ারীসহ পুলিশের অনেক কর্মকর্তা তথ্য সংগ্রহে ভূমিকা রাখেন। এসব ডকুমেন্টের সমন্বয়ে 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক ১৪ খণ্ডের বইয়ের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে।
মূলত 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ের তথ্য সংগ্রহে ভূমিকা রেখে জাবেদ পাটোয়ারী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার তাকে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জাবেদ পাটোয়ারীর ভূমিকা বিতর্কিত ছিল। তবে তার সঙ্গে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইয়ের কোনোভাবে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার কথা জানা যায়নি।
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, প্রয়াত শামসুজ্জামান খান 'বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশনার ইতিহাস-কথা' শিরোনামে ২০১৬ সালের ১৩ই আগস্ট দৈনিক প্রথম আলোতে লেখা এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, অসমাপ্ত আত্মজীবনী সম্পাদনার উদ্যোগ যখন শুরু হয়, শেখ হাসিনা তখন ছিলেন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। শামসুজ্জামান খানসহ অন্যান্যদের তথ্য বলছে, শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ডায়েরি থেকে বই প্রকাশের উদ্যোগ শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নেননি। এই উদ্যোগ আরো আগের।
শামসুজ্জামান খান লেখেন, 'আমরা যখন এই কাজটি শুরু করি প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলের নেত্রী। তিনি সুধা সদনে অবস্থান করতেন। নির্ধারিত দিনে আমরা প্রকাশনা ও সম্পাদনার কাজে যুক্ত হতাম। কাজ হতো আনন্দময় ও আন্তরিক পরিবেশে। তবে কাজ করতে হতো খুব সিরিয়াসলি এবং সতর্কতার সঙ্গে। কারণ পাণ্ডুলিপি তো আর কারও নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সকলে মিলে যখন কিছু কিছু করে পাণ্ডুলিপি তৈরি হচ্ছিল, তখন তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী নিজেই তা কম্পিউটারে কম্পোজ করে দিতেন।'
অসমাপ্ত আত্মজীবনী সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুন, সাংবাদিক বেবী মওদুদ, শামসুজ্জামান খান এবং অধ্যাপক ফখরুল আলম যুক্ত ছিলেন। বইটিতে উপস্থাপনার ধরন বিশিষ্ট লেখক-গবেষক এবং সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রশংসাধন্য হয়েছে। এমন ধরনের উপস্থাপনা জাবেদ পাটোয়ারীর পক্ষে সম্ভব নয় বলেই পাঠকেরা মনে করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’–এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ও ’বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি'র সাবেক পরিচালক ফকরুল আলম। দৈনিক প্রথম আলোতে ২০২৩ সালের ১৭ই মার্চ তার লেখা 'যেভাবে অনূদিত হলো বঙ্গবন্ধুর বইগুলো' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
এতে তিনি বলেন, ২০০৬ সালে তিনি প্রথম জানতে পারেন, শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী নামের পাণ্ডুলিপিটি বই হয়ে বের হবে। শেখ হাসিনা তখন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা। তিনি লেখেন, 'শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী, থাকেন ধানমন্ডির (ঢাকা) সুধা সদনে। ঠিক হলো, এ কাজের ব্যাপারে সুধা সদনে গিয়ে তার (শেখ হাসিনা) সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ হবে।'
ফকরুল আলম ওই লেখায় উল্লেখ করেন, 'পরে সুধা সদনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজের ব্যাপারে কথা হলো।... জানলাম, সেই ২০০০ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর লেখাপত্র নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ চলছে এবং এ কাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন আরেক বরেণ্য ব্যক্তি—যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনায়েতুর রহিম। তিনি বঙ্গবন্ধুর লেখার ইংরেজি অনুবাদের কাজও শুরু করেছিলেন।'
তিনি লেখেন, 'এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনাকে কারারুদ্ধ করা হলে (বইয়ের) কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়ে। এ সময় বেবী আপাসহ (বেবী মওদুদ) আমরা টুকটাক কিছু কাজ করেছি (সাপ্তাহিক) বিচিত্রা অফিসে বসে।...পাণ্ডুলিপি থেকে অসমাপ্ত আত্মজীবনী যখন বই আকারে প্রকাশের অবস্থায় এসেছে, তখন আমাদের দলের সঙ্গে বৈঠক করলেন ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের (ইউপিএল) মহিউদ্দীন আহমেদ। সিদ্ধান্ত হলো, একই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে বইটি বের করবে ইউপিএল। ২০১২ সালে বাংলাদেশের ইউপিএল, ভারতের পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকেও প্রকাশিত হলো বইটি।'
খবরটি শেয়ার করুন