ছবি: সংগৃহীত
ভয়ানক ঘৃণার ভাষাকে মঞ্চ দেওয়া যায় না উল্লেখ করে সাংবাদিক ও লেখিকা কাজী জেসিন বলেছেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ইন্টারভিউ (সাক্ষাৎকার) আমি সুযোগ পেলেও করব না, এমনকি কয়েক কোটি টাকা দিলেও না। আজ বুধবার (২৯শে অক্টোবর) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টের এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, 'খুনির সাক্ষাৎকার নেওয়া যাবে না, তা নয়। সাংবাদিকতার এথিক্স এটা বলে না যে, আপনি খুনির সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না। একজন খুনির সাক্ষাৎকার নেওয়ার মধ্য দিয়ে যদি আমি সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থার ত্রুটি তুলে ধরতে পারি, যদি সেই সাক্ষাৎকার জনস্বার্থে অত্যাবশ্যক হয় (উদাহরণ- অপরাধের পেছনের নেটওয়ার্ক বোঝাতে বা ভবিষ্যৎ অপরাধ রোধে ভূমিকা রাখে) তাহলে তা নেওয়া যায়।'
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা যদি সাক্ষাৎকার দিতে চান, সেক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটলেও তা নেবেন বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন। এ মন্তব্য করে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন দর্শকপ্রিয় এই উপস্থাপক। তার বক্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে অনলাইন দুনিয়ায়।
ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ওই মন্তব্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা এখনো চলছে। এমনকী তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করছেন নেটিজেনেরা। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, সাক্ষাৎকার নেওয়ার এই ইচ্ছা শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে নরমালাইজ করার চেষ্টা কি-না? গতকাল মঙ্গলবার (২৮শে অক্টোবর) আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদ মুহিউদ্দীন জবাবও দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে সমালোচনার। এ সময় কিছুটা খেদ প্রকাশ করেন খালেদ। তিনি নিজেই প্রশ্ন করেন, শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়া মানে কী তাকে নরমালাইজ করা?
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ঠিকানা’র সাংবাদিক খালেদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কাজী জেসিন ফেসবুকে এমন পোস্ট করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য বর্তমান বাস্তবতায় শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়া হলে তা বৈধতা বা নৈতিকতার দিক থেকে সঠিক হবে কিনা, তা নিয়ে সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীনের একটি বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই রয়টার্স আজ শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে।
কাজী জেসিন পোস্টে লেখেন, তথ্য সাংবাদিকের কাছে খনি। কিন্তু এই খনি আহরণ করতে গিয়ে কোনো সাংবাদিক দেশের ক্ষতি করার রাইট (অধিকার) রাখেন না।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, নরওয়ের অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক ২০১১ সালে ৭৭ জনকে হত্যা করেন। বিচার চলাকালীন অনেক সংবাদমাধ্যম তার 'আইডিওলোজি' বা বক্তব্য ছাপতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নরওয়ের আদালত ও সাংবাদিকতার নীতি-সংস্থা নির্দেশ দেয়, ব্রেইভিকের বক্তব্য প্রচার করা মানে তার ঘৃণার ভাষাকে মঞ্চ দেওয়া। ফলে অধিকাংশ মিডিয়া তার সাক্ষাৎকার সরাসরি প্রচার করতে পারেনি। তাহলে খুনি হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়া যাবে না।
কাজী জেসিন তার পোস্টে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার না নেওয়ার জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করে বলেন, প্রথমত হাসিনা সম্পর্কে আমরা জানি যে তিনি কোনো অপরাধের নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে খুন করেননি, বরং তিনি নিজেই মাফিয়া ছিলেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়ে কোনো বৃহৎ জনকল্যাণ সাধন হবে না কিংবা তিনি এমন কোনো সত্য তুলে ধরবেন না, যা এড্রেস করার মধ্য দিয়ে সমাজে বা রাষ্ট্রে অব্যবস্থাপনা দূর হবে। তাহলে খুনি হাসিনার সাক্ষাৎকার আমি কেন নেব? এথিক্যালি আমি তা করতে পারি না।
তিনি তার পোস্টে উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হান্না আরেন্ট ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে লিখেছিলেন, যখন মন্দকে একটি মঞ্চ দেওয়া হয়, তখন তা সহানুভূতির জন্য নয়, বরং তার প্রক্রিয়া বোঝার জন্য হওয়া উচিত। অর্থাৎ অপরাধীর কণ্ঠ শোনা যেতে পারে বোঝার উদ্দেশ্যে, কিন্তু সহানুভূতির উদ্দেশ্যে নয়। হাসিনার কাছে বোঝার কিছু নেই যে, কেন তিনি এতো মানুষকে এমনকি শিশুকে হত্যা করলেন। তিনি এক রক্ত পিপাসু ক্ষমতালোভী ভয়ানক ফ্যাসিস্ট!
পোস্টে তিনি লেখেন, ১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক জর্জ ওয়ার্ড প্রাইস এডলফ হিটলারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর তিনি ভয়ানকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। কারণ, এক ভয়ানক হত্যাকারীর অপরাধের ভয়াবহতার ব্যাখ্যা দিতে, তার ভ্রান্ত দিক তুলে ধরতে সেই সাক্ষাৎকার সহযোগিতা করেছিল। সেটাই করার কথা, কারণ একজন খুনির সাক্ষাৎকার নেওয়া মানেই আপনি তার অপকর্মের ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন অথবা তাকে মিথ্যা বয়ানের সুযোগ হাজির করছেন।
কাজী জেসিন তার পোস্টে হাসিনার সাক্ষাৎকার না নেওয়ার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনার বিচারের আগে হত্যা সংক্রান্ত আলাপে তার দেওয়া মিথ্যা তথ্য (যেহেতু তিনি সত্য বলেন না) তার অনুসারীদের ভেতরে বিভ্রম সৃষ্টি করতে পারে, যাদের তিনি ইতিমধ্যে প্রতিপক্ষের ওপর হামলার হুকুম দিয়েছেন, তাদের বাড়িঘরে আগুন দিতে বলেছেন। এসব মতিভ্রম নেতাকর্মীরা আরও বিভ্রান্ত হয়ে ভবিষ্যতে কী করতে পারেন, অনুমান করে নেন।
তিনি লেখেন, আমরা নিশ্চয়ই একটা সিভিল ওয়ার সিচুয়েশন চাই না! মাফিয়া, প্রতিশোধপরায়ণ ও একজন খুনির সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি নিশ্চয়ই দেশে কিছু বিপথগামী পরাজিত আওয়ামী শক্তি বাহিনীকে উস্কে দিয়ে আরও বিপথগামী করতে পারি না!
পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, তৃতীয় যে কারণে তার সাক্ষাৎকার আমি নেব না তা হলো, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের আহত করুক এমন কোনো কাজ আমি করতে পারি না।
খবরটি শেয়ার করুন