ফাইল ছবি
গত ১৪ই ডিসেম্বর কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সাংবাদিক ও টকশো আলোচক আনিস আলমগীরকে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। তাকে সেখানে আটকে রেখে পরদিন, অর্থাৎ গতকাল সোমবার তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয় এবং তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গতকাল বিকেলে আদালতে হাজিরের পর আনিস আলমগীরকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আগে আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে থানায় যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, তাতে সামাজিক মাধ্যম ও টকশোতে বসে 'আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার প্রোপাগান্ডা চালানোর' অভিযোগ আনা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছিলেন। তাকে গ্রেপ্তার করায় প্রশ্ন উঠছে, 'সরকারের সমালোচনা' গ্রহণ করা হবে না, এমন বার্তাই এর মাধ্যমে দেওয়া হলো কিনা।
আনিস আলমগীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন জাতীয় নানা ইস্যুতে। তাকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেওয়ার পর থেকে অতীতের বিভিন্ন সময় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টের স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়েছে। এর সূত্র ধরে নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনায় এসেছে সনাতন ধর্মের এক দেবীর নামে 'কটূক্তি ও অশালীন' মন্তব্য করার অভিযোগে সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়ার ঘটনাটি।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ২২শে জানুয়ারি দেবী সরস্বতী সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে 'অশালীন মন্তব্য' করেন আনিস আলমগীর। এর মাধ্যমে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল তখন। অবশ্য দেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে বহু মামলা করা হলেও হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে মামলা দায়ের করার ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না।
সনাতন ধর্ম ও দেবী সরস্বতীকে কটাক্ষ করে ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার পর আনিস আলমগীর ডানপন্থি পাঠক ও ইসলাম ধর্মপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তারা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকারেরও কঠোর সমালোচনা করতেন আনিস আলমগীর। সনাতন ধর্মকে কটাক্ষ করায় আনিস আলমগীরকে তখন অনেকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে তখন মামলাটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুশান্ত কুমার বসু। তিনি তখন এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে বলেন, সংক্ষুব্ধ হয়ে তিনি থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ মামলাটি গ্রহণ করতে রাজি না হওয়ায় তিনি সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে মামলাটি দায়ের করেন।
তিনি বলেন, 'সনাতন ধর্মে বিদ্যার দেবী সরস্বতী সম্পর্কে কটূক্তি করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।' ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলাটিকে আমলে নিয়ে ঢাকার সংশ্লিষ্ট ওয়ারী থানার পুলিশকে বাদীর অভিযোগ তদন্ত করে দেখার আদেশ দেন।
আসামী আনিস আলমগীর তখন গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছিলেন, 'দেবী সরস্বতীর সৌন্দর্যের প্রশংসা করে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। তাতেও যারা আহত হয়েছেন, আমি তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি। এই ঘটনার পর আমি আমার ভুলের কথা স্বীকার করে তিনবার দুঃখ প্রকাশ করেছি। সারা জীবন আমি মানবতার পক্ষে ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি। তারপরেও আমার একটি ভুলকে ইস্যু বানিয়ে মামলা করা হয়েছে।'
ফেসবুকে আনিস আলমগীরের স্ট্যাটাসের পর এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে তিনি স্ট্যাটাসটি ফেসবুক থেকে মুছে দেন এবং পরে তার ব্যাখ্যা দিয়ে আরো দুটি স্ট্যাটাস দেন। আনিস আলমগীর বলেন, 'মামলা যখন হয়েছে তখন আর কি করা। আদালতের কাছে আমি আমার বক্তব্য তুলে ধরবো।'
আনিস আলমগীরই দেশের একমাত্র সাংবাদিক, যিনি ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি সংবাদ পরিবেশন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে পড়াশোনা করা আনিস আলমগীর দৈনিক দেশ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
তিনি আজকের কাগজ ও ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলেন। পরে আরটিভি ও বৈশাখী টিভির বার্তা প্রধান এবং চ্যানেল আইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে দৈনিক আজকের কাগজের পক্ষে ইরাক যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। সে সময় চ্যানেল আই এবং বিবিসি বাংলায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি তার সংবাদ পরিবেশিত হলে তা দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করে।
আনিস আলমগীর ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহকালে তালেবানদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। জাতীয়ভাবে তার আলোচিত প্রতিবেদনের মধ্যে ছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ফুটেজ দিয়ে রিপোর্ট প্রচার। ঘটনার ৩২ বছর পর ২০০৭ সালের ১৫ই আগস্ট বৈশাখী টিভিতে প্রথমবারের মতো ওই ফুটেজ দিয়ে সংবাদ প্রচার করেন তিনি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন তিনি। তার জন্ম চট্টগ্রামে।
খবরটি শেয়ার করুন