ছবি: সংগৃহীত
অতীতে জামায়াতে ইসলামী ও উগ্র সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশকে (জেএমবি) দেশে নিষিদ্ধ করায় রাজনৈতিকভাবে কোনো লাভ হয়েছে কী না, প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তার প্রশ্ন, 'এসব নিষেধাজ্ঞা কি কখনো কাজে এসেছে? এভাবেই কি চলতে দেওয়া উচিত?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের তিনদিন আগে ৫ই আগস্ট ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম এই প্রশ্ন সামনে এনেছেন। ‘হোয়াই উয়ি আর ট্রায়িং টু মেইক দ্য ইলেকশন আনসার্টেইন’ শিরোনামে তার লেখাটি প্রকাশিত হয়।
তার লেখার লিংক ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে নানামুখী আলোচনা চলছে নেটিজেনদের মধ্যে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, ডাকসুর নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে কৌশলে ভোট বাড়াতে তিনি এ উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। তার লেখাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানচিন্তার শিক্ষার্থীদের ভোট-ভাবনায় প্রভাব ফেলেছে।
পাকিস্তানিদের আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বাধীন দেশে ধর্মভিত্তিক সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টিকে মাহফুজ আনাম আলোচ্য উপসম্পাদকীয়তে জঙ্গি সংগঠন জেএমবিকে নিষিদ্ধ করার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন বলেও অনেক নেটিজেনের অভিযোগ।
তারা বলছেন, এই প্রথম দেশের কোনো প্রবীণ সাংবাদিক ও সম্পাদক আওয়ামী লীগ (একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কার্যক্রম নিষিদ্ধ), জামায়াত ও জেএমবি নিষিদ্ধ করাকে একই বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে মতামত প্রকাশ করলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে পাকিস্তানিরা বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট' চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার (৯ই সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত ডাকসুর ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, মোট ২৮টি পদের ২৩টিতেই জিতেছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল। শীর্ষ তিনটি পদে শিবিরের প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে মূলত বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের। তবে ডাকসুর অন্য পদগুলোয় ছাত্রদলের প্রার্থীরা উল্লেখযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেননি।
মাহফুজ আনাম উপসম্পাদকীয়তে বলেন, ‘১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি সব ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মাওবাদী চরমপন্থী দল পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি ও পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়। ...২০০৫ সালে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিষিদ্ধ হয়। গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার পতনের মাত্র চারদিন আগে ২০২৪ সালের ১লা আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করেন হাসিনা (ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী)—পরে অন্তর্বর্তী সরকার সেই আদেশ তুলে নেয় এবং দলটি এখন আমাদের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবক।’
তিনি বলেন, ‘জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের মার্চে অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি সব ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। ...১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই বুঝতে হবে যে, আজকের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে ভালো পথ হলো একটি যথাযথ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন করা, যেখানে নির্বাচিত সংসদ হবে জনগণের ইচ্ছার ভাণ্ডারের প্রতিফলন। নির্বাচন কেবল আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্যই নয়, বরং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিতের জন্যও প্রয়োজন। নির্বাচন ছাড়া আস্থা তৈরি হবে না—যা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পূর্বশর্ত। আর বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।’
তিনি লেখেন, ‘যারা নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করছেন, তাদের নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত—নির্বাচন ছাড়া কীভাবে জনগণের ক্ষমতায়ন সম্ভব? পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া শুরুর একটিই উপায়, আর সেটি হলো জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া—যাতে তারা নির্ধারণ করতে পারে, কে সরকার গঠন করবে এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে।’
প্রসঙ্গত, পুরো বিশ্বের কাছে জেএমবি তাদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছিল অনেকটা নাটকীয়ভাবে, ২০০৫ সালের ১৭ই অগাস্ট সারাদেশে একযোগে বোমা ফাটিয়ে। বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনার পর এটিকে নিষিদ্ধ করে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বের চারদলীয় জোট সরকার। ফাঁসি দেওয়া হয় সংগঠনের প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, বহুল আলোচিত সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ ছয়জনকে।
খবরটি শেয়ার করুন