ছবি: সংগৃহীত
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-উর-রশীদ আসকারীর নামে একটি 'ভিডিও' ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া 'ভিডিও'তে বিবস্ত্র এক পুরুষকে দেখা যায়, এক নারীকে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার প্রস্তাব দিতে।
ছবিতে মধ্য বয়সী এক পুরুষকে একদম নগ্ন দেখা যায়। তার শরীরের 'প্রাইভেট পার্টে'ও কোনো কাপড় নেই। ভিডিওতে একপর্যায়ে লোকটিকে নিজের গোপনাঙ্গের দিকে তাকিয়ে বিশেষ অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা যায়। সুখবর ডটকমের কাছে কথিত যে ভিডিওটি এসেছে, তা দেড় মিনিটেরও কম সময়ের।
তবে রশীদ আসকারীর স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনেরা সুখবর ডটকমকে জানিয়েছেন, ভিডিওটি মোটেও তার নয়। এটা ভুয়া ও বানোয়াট ভিডিও। ভিডিওর কণ্ঠের সঙ্গে তার কণ্ঠের কোনো মিল নেই। গত বছরের ৫ই আগস্ট থেকে রশীদ আসকারী আত্মগোপনে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
'ভাইরাল' হওয়া পুরো ভিডিওটি অস্পষ্ট। সুখবরের অনুসন্ধান বলছে, রশীদ আসকারীর নামে ওই নগ্ন 'ভিডিও' মূলত ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণপন্থী কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে। এসব অ্যাকাউন্ট কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির বদলে নানা নামে পরিচালিত হচ্ছে।
তবে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেকে ধরে নিয়েছেন, কথিত ওই ভিডিও রশীদ আসকারীর বিশেষ মুহূর্তের। ভিডিওটির বিভিন্ন লিংকে তাদের মন্তব্য ও সেটি শেয়ার করা থেকে তা অনুমান করা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, নিয়োগ পাওয়ার ১৮ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশীদ আসকারী। ২০২৪ সালের ২৪শে জুলাই তাকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে বসায় আওয়ামী লীগের সরকার। যোগদানের দিন থেকে পরবর্তী তিন বছর মেয়াদে তাকে এ নিয়োগ দেওয়া হলেও গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে তিনি আর ওই পদে থাকতে পারেননি।
আওয়ামী লীগের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী শিক্ষক রশীদ আসকারী ১৯৯০ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। উপাচার্য থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তিনি আর প্রকাশ্যে নেই।
অনেকে বলছেন, এআই সফটওয়্যার বা অ্যাপ ব্যবহার করে বিভিন্ন মানুষের ছবি এডিট করে সেখানে অশ্লীল, নগ্ন ছবি বা ভিডিও বানিয়ে দেওয়া যায় খুব সহজে। যার ভুক্তভোগী ইতিমধ্যে দেশের অনেকেই হয়েছেন। সবশেষ এই তালিকায় যুক্ত হলেন রশীদ আসকারী। তার নামে ছড়িয়ে পড়া 'ভিডিও'টি ভুয়া এবং তা এআই দিয়ে বানানো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন, 'আমরা শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত যে স্তরেরই হই, একটা ফেক ভিডিওকে আমরা তখনই লুফে নিচ্ছি, যখন সেটা আমার কিংবা আমার দলের মতাদর্শের সঙ্গে যাচ্ছে আর বিরোধীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। আবার ভুল হলে নামিয়ে ফেলছি, কিন্তু এর মধ্যেই একটা ডিজাস্টার (ক্ষতি) হয়ে গেল।'
গুগলের ভিউ টুলস দিয়ে ভুয়া ভিডিও তৈরি করা যায় দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে। এতে খরচও হয় খুবই সামান্য। মাত্র হাজার দুয়েক টাকায় কেনা যায় হাজার ক্রেডিট, যা দিয়ে বানানো যায় প্রায় ৫০টি ভিডিও। কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে বিনামূল্যেই এসব টুলসে এক্সেস করা যায়।
অনুসন্ধানে ও বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই দিয়ে তৈরি নানাজনের নগ্ন ছবি, ডিপফেক ভিডিও। প্রযুক্তি যত এগিয়েছে, মানুষকে ধোঁকা দেওয়া বা বোকা বানানো তত সহজ হয়েছে।
যে কোনো সংকটে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরও বেশি করে ছড়ায় এ ধরনের ছবি। এআই ফটোগ্রাফারদের কখনো উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, কখনোবা নিছক গুজব ছড়িয়ে মজা নেওয়া। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগতভাবে দেশের প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত যৌন মুহূর্ত ও নগ্ন ছবি এভাবেই ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোসফটস এআই ইমেজ জেনারেটর, মিডজার্নি, ডাল ই, ডিপএআই—এ রকম বিভিন্ন ইঞ্জিন ব্যবহারের মাধ্যেম ছবি তৈরি করে এআই। সাধারণত পাবলিক ডোমেইনে থাকা অন্য ছবি থেকে তথ্য নিয়ে ছবি বানায়। ফলে এআইয়ের বানানো ছবিতে কিছু অসঙ্গতি থেকে যায়।
ব্যক্তির ছবিতে, বিশেষ করে হাত, পা ও আঙুলে অসামঞ্জস্য দেখা যায়। হাত ও পায়ের আঙুল দেখতে অস্বাভাবিক লাগে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষ করে হাত ও পায়ের আকৃতি অন্য রকম দেখায়। অনেক সময় হাত ও পায়ের অবস্থান, দিক ঠিক থাকে না। রশীদ আসকারীর নামে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে এমন অসংগতি লক্ষ্য করা গেছে।
এআইয়ের বানানো ভিডিও ও ছবিতে মানুষের চেহারা সাধারণত বেশি ‘গ্লো’ করে। ‘শার্পনেস’ থাকে না। এআই দিয়ে বানানো মানুষের চেহারার ভেতরে একটু কার্টুন-কার্টুন ভাব থাকতে পারে। মানুষের চোখের মণির খুঁটিনাটি সাধারণত পাওয়া যায় না।
এ ছাড়া ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললে ওই ছবি তোলার কিছু তথ্য পাওয়া যায়, যেমন কোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা, কবে, কখন তোলা, কে তুলেছে, ছবি তোলার সময়কার বর্ণনা ইত্যাদি। এআই দিয়ে বানানো ছবিতে স্বাভাবিকভাবেই তা থাকবে না। রশীদ আসকারীর ভিডিও ও ছবিতে তেমনি দেখতে পাচ্ছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
খবরটি শেয়ার করুন