ছবি - সংগৃহীত
রবিউল হক
বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্তে লোকধর্ম সম্পর্কে ভিন্ন ধারণা পাওয়া যায়। ঐতিহ্যনির্ভর লোকধর্ম, জাতি-গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে কেবল মানবতার জয়গান করে। পঞ্চগড় জেলায় লোককাহিনীর পাশাপাশি লোকপুরাণ বেশ জনপ্রিয়। এ অঞ্চলে লৌকিক পীর ও লৌকিক দেব-দেবীর আরাধনা বেশ প্রাচীন। লৌকিক পীর ও লৌকিক দেব-দেবীর আরাধনার অন্যতম প্রধান দিক হলো সকল ধর্মের মানুষের মিলন ঘটে এ জায়গায় যেখানে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে মানুষ হিসেবে পরিচয় মেলে। পঞ্চগড় জেলার লৌকিক পীরদের মধ্যে রয়েছেন- পাচপীর, সত্যপীর, খোয়াজ পীর, চিল পীর, ঢেল পীর, মাদার পীর, চুন খাওয়া পীর, মানিক পীর, কালু পীর, কাউয়া পীর, গাজী পীর, সোনা পীর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন নির্জন প্রান্তরে পীরদের মাজার অবস্থিত, সেখানে অসংখ্য ভক্তকুল নিয়মিত ওরস ও মাহফিলের আয়োজন করে থাকে। লৌকিক পীরদের বিশ্বাস তারা প্রতীক হিসেবে আত্মারূপে মানবমনে বিরাজ করে। এছাড়া পীরানি হিসেবে এ অঞ্চলে ওলাবিবি, বনবিবি, বাংধীপীর, বুড়িপীর, কানীপীর, বিবি নুর, বিবি সাহেবানী, বেকীপীর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। ‘লাঠি’ হচ্ছে গাজীপীরের, ‘বাঁশ’ মাদারপীরের, আর ‘পাট’ হচ্ছে সত্যপীরের নিশান।
পঞ্চগড় জেলায় লৌকিক দেব-দেবীর যে চর্চা রয়েছে তার উদ্ভব বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্মের আদিম সমাজে এমন ধারণা গবেষকদের। বৈদিকদের ধর্ম সাধনার মূল পন্থা ছিল তন্ত্র বা যজ্ঞ। তবে বর্তমানে বৈদিক বা পৌরাণিক দেবতাদের পূজার পাশাপাশি পালিত হয় অসংখ্য লোকায়ত দেব-দেবীর পূজা-পার্বণ ও ব্রত্যানুষ্ঠান। এ জেলায় লৌকিক দেব-দেবীর মধ্যে কানী বিষহরী বা কান্দনী বিষহরা, হনুমান ঠাকুর, সন্ন্যাসী ঠাকুর, গোঙ্গা ঠাকুর, গ্যারাম ঠাকুর, ভেদাই ঠাকুর, বুড়া ঠাকুর, বুড়ি ঠাকুর, মেচেনী তিস্তা বুড়ি, বুড়া ধেল্লা, ভুইরাজা, মাষাণ কালী, মাশান দেও মেথেনী দেও, ভদ্র কালী, শ্যামা কালী, শ্মশান কালী, হাদাং কালী, কাচাখুই কালী, শীতলা, বাসন্তী, বিষহরি, সোনা রায়, গোরখনাথ, শলশিরি দেবী, গঙ্গা দেবী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এ জেলায় লৌকিক পীর ও দেব-দেবীদের পূজায় যেসব জিনিস অপরিহার্য তার মধ্যে মোমবাতি, আগরবাতি, ধূপ, জিলাপি, বাতাসা, নিমকি, দুধ, দই, ক্ষীর, খৈ, মুড়ি, আতপ চাল, ধান, মুরগি, হাঁস, পাঠা, কবুতর, ছাগলের বাচ্চাসহ আরো বেশ কিছু উপকরণ। ভক্তদের ডাকে পীর বা দেব-দেবীগণ বিপদে পাশে দাঁড়ান এই বিশ্বাস থেকেই তাদের আরাধনা। মূলত মানুষ সরল জীবনযাপনের মধ্যে লৌকিক দেব-দেবীর আরাধনায় নিজেদের জীবনের মর্ম খোঁজার চেষ্টা করেন।
তথ্যসূত্র
১. মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত, অনার্য, ঢাকা, ২০১১
২. নাজমুল হক, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্যের নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭
৩. শামসুজ্জামান খান, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৩
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/