মঙ্গলবার, ২২শে জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ই শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** ইস্তাম্বুলে শান্তি আলোচনায় বসতে যাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন *** গত বছর ব্রিটেনে আশ্রয়প্রার্থীদের শীর্ষে পাকিস্তানিরা, বাংলাদেশিরা চতুর্থ *** বিচার বিভাগ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান নিয়োগে একমত বিএনপি-জামায়াত *** শিক্ষাসচিবকে প্রত্যাহার, জানালেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম *** মাইলস্টোনে আহতদের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে আসছে চিকিৎসক দল: শ্রম উপদেষ্টা *** সেপ্টেম্বরের মধ্যে মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের বহর বাতিল করবে ভারত *** বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় আজ রাষ্ট্রীয় শোক *** সংসদে সংরক্ষিত আসন চায় দলিত সম্প্রদায় *** উত্তরায় বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নরেন্দ্র মোদির শোক *** সাগরিকার হ্যাটট্রিকে নেপালকে উড়িয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

ভাষা আগ্রাসন : নেব্রিয়া যার পথিকৃৎ

কানাই চক্রবর্তী

🕒 প্রকাশ: ০৩:০৯ অপরাহ্ন, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫

#

ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

এটা ঠিক তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাঙালিদের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। ভারতের মতো পাকিস্তানে বহু ভাষা-ভাষীর অস্তিত্ব না থাকলেও শুধু উর্দু এবং বাংলা ভাষার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে ভাষা সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। আসলে পাকিস্তানের  ভাষাভিত্তিক সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। ভাষা সমস্যা হচ্ছে তাদের, এক কথায় বিশাল একটা ভূখণ্ডকে নিয়ে যারা একটি মাত্র আঁটোসাটো নেশন রাষ্ট্র গড়তে চান। মূলত এটা তাদের সমস্যা। ভাষার বৈচিত্র্যকে তারাই ভয় পান। কারণ, সেই বৈচিত্র্য তাদের আকাঙ্ক্ষার মূলে গিয়ে আঘাত করে। 

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই বুঝতে পেরেছিল একমাত্র ধর্মীয় ঐক্যের মাধ্যমে এবং ভৌগোলিক ব্যবধানের কারণে বাঙালিদের পাকিস্তানের সাথে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না। ধর্মীয়ভাবে যে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষা করা যেতো না তা মৃত্যুর আগে জিন্নাহর একটি উক্তি প্রমাণ করেছে। জিন্নাহ যিনি পাকিস্তানের স্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তিনি মৃত্যুর আগে তার ডাক্তারকে বলেছিলেন, দ্বিজাতি তত্ত্ব ধারণাটি তার জীবনের বড় ভুল ছিল। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- দেশ ও নেশন রাষ্ট্রের ধারণাটি পাকিস্তানের মাথায় কিভাবে আসে। আসে এই কারণে যে পাকিস্তান এই বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়, অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের এই অংশটি (বাংলাদেশ) ভাষাকে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে। আর তাই শুরুতেই বাংলাদেশকে মুঠোবদ্ধ করে রাখার জন্য বাংলা ভাষাকে তারা আপদ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। দুই পাকিস্তানে যেহেতু তারা সংখ্যালঘু (ভাষাগত) ছিল, আর অল্পসংখ্যক লোকের হাতে ছিল বিপুল ক্ষমতা। সে কারণেই বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে পাকিস্তানিরা আপদ বলে মনে করতো।

প্রকৃতপক্ষে নেশন রাষ্ট্রের ধারণাটি ফরাসি বিপ্লবের সময়ে জন্ম। নেশন রাষ্ট্রের নির্মাতারা অনেক ভাষার জায়গায় কেবল একটিকে বুঝতে চান। এর ফলে ছোট ছোট গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়। তারা শাসকের হাতের খেলার পুতুল হয়ে পড়েন। 

সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ ভাষাকে ওই ধরনের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। আঞ্চলিক ভাষাগুলো যে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তা নয়, কিন্তু রুশ ভাষাই ছিল সরকারি মান্যতাপ্রাপ্ত একমাত্র বারোয়ারী ভাষা। এমনকি একটি আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ করা যেতো না। অনুবাদটি হতো রুশ ভাষার মাধ্যমে। তবে এটি ঠিক, সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি শক্তপোক্ত নেশন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হলেও পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আইডিওলজি আর সেনাবাহিনীর বন্ধনে তাকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায়নি। এই নেশন রাষ্ট্রের ধারণাটি বর্তমানে ভারতের মতো বহু বিচিত্র দেশও চিন্তা-ভাবনা করছে বলে অনেকেই মনে করেন। 

আসলে শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার হাতিয়ার হিসেবে ভাষাকে ব্যবহার করবার চিন্তাটি অনেক বছরের পুরনো। মিলিত আকারে এ ধরনের প্রথম প্রস্তাব দেন স্প্যানিশ ভাষাতত্ত্ববিদ এলিভ আন্তেনিও ডি নেব্রিহা। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত তার কাস্তিলিও ভাষায় ব্যাকরণে এর ভূমিকায় তিনি স্পেনের প্রবল প্রত্যাপান্বিত রানী ইসাবেলার উদ্দেশে লেখেন, ‘হে আমার সুবিখ্যাত রাজ্ঞী, লিখিত আকারে সংরক্ষিত অতীতের নিদর্শনগুলোর কথা যখনই ভাবি বার বার একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমি বাধ্য হই, ভাষা জিনিসটা বরাবরেই সাম্রাজ্যের দোসর হয়ে ঠেকেছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। একই সাথে তাদের উদ্ভব হয়, এক গোত্রেই তারা বেড়ে ওঠে এবং প্রস্ফূটিত হয়, আর তাদের অবক্ষয়ও ঘটে এ সঙ্গে।’

 এই কাস্তিলীয় ভাষা হচ্ছে স্পেনের কাস্তিল প্রদেশের মাতৃভাষা, কালক্রমে যা সমগ্র স্পেনের পোশাকি ভাষা হয়ে ওঠে। কাস্তিলীয় ভাষায় সেই ভূমিকাটি ছিল তারই ইস্তেহার। বেশ কম বয়সেই নেব্রিহা বুঝতে পেরেছিলেন যে, স্পেনে লাতিন ভাষায় যে অবস্থা হয়েছে তাতে সে ভাষা দিয়ে আর কাজ চলবে না। শুধু লাতিন কেন, ধ্রুপদী কোনও ভাষাই কখনো সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা হয়ে উঠবে না।

একদিকে স্পেনের রাজার অধীনে তখন নতুন যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তার ক্ষমতা আর সংস্কৃতির বাহনরূপে সার্বজনীন একটি ভাষার দরকার ছিল। আধুনিক রাষ্ট্র শক্তির সঙ্গে ভাষার এই সংযোগের ব্যাপারটা যে নেব্রিহা বুঝতে পেরেছিলেন, এটিই তার বড় কৃতিত্ব। ইতোপূর্বে তিনি একখানি লাতিন ব্যাকরণ লিখেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র ভাষার খোঁজে না গিয়ে স্পেনের অন্যতম মাতৃভাষা কাস্তিলীয় ভাষাকেই সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়ে সমগ্র দেশ এবং নির্মীয়মান সাম্রাজ্যের আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মধ্যে এটিই হলো প্রথম ব্যাকরণ। ১৪৯২ সালেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস পশ্চিম গোলার্ধের প্রথম ভূখন্ড সান্তোদোমিঙ্গোয় স্পেনের পতাকা তোলেন। এর ফলে ক্রমশ লাতিন আমেরিকার যে বিশাল অঞ্চল গড়ে উঠলো নেব্রিহার সৃষ্টি নতুন স্প্যানিশ ভাষাই হলো সেখানে স্প্যানিশ সংস্কৃতি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাহন। নেব্রিহা বললেন, ভাষাই হবে মানুষের মন আর মস্তিকের ওপরে রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের প্রধানতম হাতিয়ার। ভাষাকে রাজনীতির কাজে লাগানোর এই চিন্তা অবশ্যই খুব আধুনিক। যেন চিন্তার ফলপ্রসূতাও অবিসংবাদিত। উত্তরে মেক্সিকো থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার শেষ প্রান্তে তিয়েরা দেল ফুয়েগো পর্যন্ত বিস্তৃত হিস্পানি ভাষা ও সংস্কৃতির পরিসরটা দেখলেই তা বোঝা যায়। আসলে নেব্রিহার প্রস্তাবিত ভাষায় ওই কারিগরির মধ্যে কিছু কিছু উপাদান ছিল যা রীতিমত চমকপ্রদ। 

নেব্রিহা তার প্রস্তাবে শুধু প্রজা-সাধারণের মুখের ভাষা সংস্কার করে নিয়ে তাকে একটা ব্যাপক প্রামাণ্য রূপই দিতে চাননি। ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতিও তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। এমনকি প্রজাবর্গ কী ধরনের বই পড়বেন, কিভাবে পড়বেন, আর কিভাবে পড়বেন না- সেটাও বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। এর আগে ইউরোপে ধাতু নির্মিত সচল হরফের সাহায্যে ছাপার কাজ শুরু হয়েছিল। সময়টা ঠিক পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। প্রথমদিকে তা প্রধানত ধর্মগ্রন্থ প্রকাশের কাজেই ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু ক্রমশ জনপ্রিয় বইপত্র প্রকাশের ব্যাপারে ছাপাখানার উপযোগিতা স্পষ্ট হলো এবং ছাপা বইয়ের চাহিদাও বাড়তে থাকে। পনের শতকের শেষের দিকে জনসাধারণের মধ্যে নানা রকম কাহিনী আর উপাখ্যান পড়ার রেওয়াজ যথেষ্ট ছড়িয়ে পড়েছিল। এসব নিয়ে তখনও কেউ মাথা ঘামায়নি। জনপ্রিয়, কিন্তু এটিকে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদজনক মনে করে তিনি রানী সাহেবাকে লিখলেন, ‘আমি বরাবরই চেয়েছি আমাদের দেশ আরো বড় হোক এবং দেশের মানুষ এমন বই পড়ুক যা তাদের অবসর যাপনের পক্ষে যথার্থই উপযোগী। কিন্তু তারা উপন্যাস আর আজে-বাজে কাহিনী পড়ে সময় নষ্ট করে।’ নেব্রিহার এই আপাতত দরদী অভিযোগের পেছনে যে অন্য গুঢ় উদ্দেশ্য ছিলো তা একটু ব্যাখ্যায় গেলে জলের মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। তিনি কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে রানী সাহেবাকে এই অভিযোগ করেননি। 

স্পষ্টতই নেব্রিহা চেয়েছিলেন, দেশের লোক এতো বইপত্র না পড়ুক। এর আগে পড়াশোনা করতো অল্পসংখ্যক মানুষ। তখন বই বলতে বুঝানো হতো লেখা পান্ডুলিপি, যার সংখ্যা কখনো বেশি হতে পারতো না। বিশেষ কোনো পান্ডুলিপি কর্তৃপক্ষের কাছে অপ্রীতিকর হলে সবক’টি চালু পান্ডুলিপি আটক করে নিয়ে বাজেয়াপ্ত করা যেতো। ছাপাখানার কল্যাণে এখন সেটা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেলো। প্রথম যুগে একেকটা বইয়ের সংস্করণ হতো দশ থেকে বড় জোর হাজার কপির মতো। তবুও সবক’টি বই বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হতো না, বেগতিক দেখলে বড়জোর বিশেষ বিশেষ বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যেতো। আসলে নেব্রিহা স্পেনের রানী সাহেবার কাছে যে আবেদন করেছিলেন তা হলো- বইপত্র ছাপা হোক, তবে তা দেশের আপামর জনসাধারণের মুখের ভাষায় নয়। এভাবে লোকের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তারা কী পড়বে না পড়বে সেটি নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এতে করে জনসাধারণের চিন্তা-ভাবনার ওপরও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হবে। নেব্রিহার প্রস্তাবের আর একটি অংশ ছিল আরো চমকপ্রদ।

ছাপাখানার সেই আদিযুগে অক্ষর জ্ঞান খুব বেশি লোকের ছিলো না। ফলে হাটে-বাজারে সকলকে শুনিয়ে চেঁচিয়ে বই পড়ার একটা নিয়ম বা রেওয়াজ তৈরি হয়েছিল। পাঠককে ঘিরে রীতিমত একটা জমায়েত হতো। নিজের ঘরে বসে যে চুপচাপ বই পড়া যায় তখনো আবিষ্কার হয়নি। নেব্রিহা কিন্তু সেই পনের শতকেই প্রস্তাব করলেন চেঁচিয়ে পড়াটা যেন রাজ আদেশে বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকে যে শুধু  যা তা পড়ছে তাই নয়- বড্ড বেশি পড়ছে এবং অন্যের পড়া শুনছে। মুখ বুজে পড়ার হুকুম দেয়া হলে বই পড়া এবং শোনার এই মহামারি বন্ধ হয়ে যাবে। বরং রাজা যা চান প্রজারা তাই পড়বে। এতে প্রজাদের চিন্তার পায়ে শেকল পরিয়ে দেয়া যাবে। আর রাজার ক্ষমতাও বেড়ে যাবে। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে পাকিস্তানিরা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের প্রতি যে কূটচাল চালিয়েছে সেসব চিন্তা-ভাবনার সাথে নেব্রিহার চিন্তা-ভাবনার কোনো সম্পর্ক ছিল কি-না? 

শুরু থেকেই পাকিস্তান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যেভাবে উঠে-পড়ে লেগেছিলো তা শুধু পশ্চিমাদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখার জন্যই আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব। রবীন্দ্র সংগীতসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অবরুদ্ধতা সবকিছুর মূলে ছিল বাঙালির চিন্তার স্বাধীনতা হরণ। বাঙালিদের চিন্তার পায়ে শেকল পরিয়ে দেয়ার সেই প্রচেষ্টা যদিও সার্থক হয়নি তবুও বলা যায় বাঙালিদের আজীবন ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে নেব্রিহার চিন্তা-ভাবনা যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিলো তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের।

অন্যদিকে কাকতালীয়ভাবে নেব্রিহার চিন্তা-ভাবনার সাথে পাকিস্তানি শাসকদের চিন্তার ঐক্য মিলেমিশে থাকাটাও বোধহয় অবান্তর নয়। এখানে চিন্তার ঐক্যটি বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।    

সূত্র : ভাষা সমস্যা এবং রাষ্ট্রের গড়ন, দীপঙ্কর চট্রোপাধ্যায় 

কেসি / আই.কে.জে

ভাষা

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন