ছবি - সংগৃহীত
বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনযাপনে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি রয়েছে স্বকীয়তা। তাদের উৎসব, ধর্ম, শিক্ষা, ভাষা প্রভৃতি নিয়ে লিখেছেন সাংবাদিক নিখিল মানখিন। আজ প্রকাশিত হলো [৮ম পর্ব]।
নিখিল মানখিন
বাংলাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে লুসাই অন্যতম। তারা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। দেশের তিন পার্বত্য জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তারা। ভারতের মিজোরামে লুসাই জাতির বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে। তাদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘চাপচর কুট’। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থা চরম হুমকির মুখে। লুসাই সমাজ ব্যবস্থা মূলত পিতৃতান্ত্রিক।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক পল্লব চাকমা সুখবর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে লুসাই জাতির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। দেশে তাদের মোট জনসংখ্যা দুই হাজারেরও কম। মিজোরামের লুসাই পাহাড় এলাকায় মূল জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশে তাদের বসবাস মূলত রাঙ্গামাটি সদরের বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক উপত্যকায় এবং বান্দরবানের জেলা সদর ও রুমায়। তারা নিজেদের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলে পরিচয় দেয়।
বিবাহ:
আদিবাসী নেতা ডেভিড লুসাই সুখবর ডটকমকে বলেন, খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর লুসাই জাতির বিবাহ অনুষ্ঠানে খ্রিস্টধর্মীয় রীতিনীতি পালন অনেকটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাত্র-পাত্রীর পছন্দেই অধিকাংশ বিয়ে হয়ে থাকে। তবে উভয় পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিতে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। লুসাই সমাজে স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘ইননেইহয়না’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লুসাই বিবাহিত দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। উপরোক্ত রীতি অনুসরণ ব্যতীত লুসাই সমাজে নর-নারীর দৈহিক মিলন ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয়।
বিয়ের সামাজিক রীতি অনুসারে পাত্রপক্ষের তরফ হতে ‘পালাহ’ (ঘটক)-এর মাধ্যমে পাত্রীপক্ষের অভিভাবকের নিকট বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে হয়। পাত্রীর অভিভাবকের সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রীর পিতামহ অথবা তার অবর্তমানে পাত্রীর পিতার দাবী অনুসারে পাত্রপক্ষকে কনেপণ দিতে হয়। কনেপণ বাবদ গবাদি পশু অথবা সমমূল্যের টাকা প্রদান করতে হয়। কনেপণ দিতে ব্যর্থ হলে পাত্রের ঔরসজাত পুত্র কিংবা নাতি পর্যন্ত এই পণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। কনেপণ (মান ইন হ্লান) প্রদানের দিনেই কনেপক্ষ ভোজের আয়োজন ও বিয়ের দিন (ইননেইহয়না) ধার্য করে। এই অনুষ্ঠানে বরপক্ষ এসে ‘ইননেইহয়না’ সম্পন্ন করে। অনুষ্ঠানের এক মাস পর বর-কনের দেখা এবং বরের বাড়িতে কনে বউ নেয়া হয়।
বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে চার্চে ‘বান’ প্রকাশের মাধ্যমে লুসাই পাত্রপাত্রীর বিবাহ হয়। খ্রিস্টীয় রীতিতে একই সময়ে একাধিক বিয়ের অনুমতি নেই। লুসাই সমাজে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার ক্ষেত্রে সাবালক হবার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সাবালকত্ব অর্জনের বিষয়টিকে সমাজে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। সাবালকত্বের মাপকাঠি হিসেবে পাত্রের বেলায় ‘থুরুং’ (বেতের তৈরি বড় ঝুড়ির বিশেষ) তৈরি, জুম চাষ, ঘরবাড়ি তৈরির কাজে পারদর্শী এবং ভারবহনের ক্ষমতার অধিকারী কিনা যাচাই করা হয়।
সৎকার রীতিঃ
মার্থা লুসাই সুখবর ডটকমকে বলেন, লুসাই সমাজে সামাজিক বন্ধন খুব শক্তিশালী। একে অপরের সমস্যা নিরসনে তারা প্রত্যেকে বেশ আন্তরিক। কারো মৃত্যু হলে গ্রামবাসী সবাই মৃতের জন্য শোক প্রকাশ করতে হয়। লুসাই সমাজে মৃত্যুর পর মৃতদেহ কবর দেয়া হয়। সমাজের আদি রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার উদ্দেশে পশু বলি দিয়ে ভোজের আয়োজন করা হয়। তবে বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের পর এ প্রচলন এখন নেই। খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে কবর দেয় এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
সামাজিক রীতিনীতি ও উৎসব:
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং সুখবর ডটকমকে বলেন, একের পর এক সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে মেতে উঠে লুসাই সম্প্রদায়। ধর্মীয় উৎসব পালন ছাড়াও বছরে তারা প্রধান তিনটি উৎসব পালন করে থাকে। যেমন- চাপচারকূত (বসন্ত উৎসব), মীমতূত (মৃত আত্মাদের স্মরণে) এবং পলকূত (শস্য কাটার উৎসব)। এছাড়াও রয়েছে চাপচার কুট, মিনকুট, পাল কুট। তাদের মাতৃভাষায় রচিত বিভিন্ন গান ও আদি নৃত্য। মনকুট উৎসব- জুমের ঘাস কাটার যখন শেষ হয় তখন এই উৎসব করা হয়। চাপচার কুট হলো নবান্ন উৎসব। জুমের ধান কাটা শেষ হলে এই উৎসব করা হয়। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। যুবকরা কবর প্রস্তুত করে এবং একটি পাথরে মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ এবং তার গ্রাম ইত্যাদি লিখে কবরের উপর মাটিতে পুঁতে রাখে।
এক সপ্তাহ ধরে চলে খ্রিস্টমাস বা বড়দিনের আনন্দ উৎসব। প্রার্থনা, কেক কাটা, নাচ-গানের মধ্য দিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে লুসাই সম্প্রদায়। বড়দিনকে ঘিরে আনন্দমুখর হয়ে উঠে লুসাই পল্লীগুলো। গির্জাগুলো নানা সাজে সাজানো হয়। সকালে গির্জায় গির্জায় প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বড়দিনের উৎসব। বান্দরবান শহরের লুসাই বাড়ি গির্জা, ফাতিমা রাণী ক্যাথলিক গির্জা, কালাঘাটা ত্রিপুরা পাড়া গির্জা নতুন ব্রিজ ইসিবি গির্জাসহ বিভিন্ন স্থানে সকালে যিশুখ্রিস্টের সম্মানে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। শহরের কাছে চিম্বুক পাহাড়ের ফারুক পাড়া, লাইমী পাড়া, গ্যাস্বমনি পাড়াসহ সেখানকার বম সম্প্রদায়ের পাড়াগুলোতে বড়দিনে উৎসবের বন্যা বয়ে যায়। নতুন কাপড় পরে গির্জায় গিয়ে প্রার্থনায় অংশ নেয় সবাই। এছাড়া পাড়ায় পাড়ায় ভোজের আয়োজন করা হয়।
শিশুর জন্মশুদ্ধি ও আচার-অনুষ্ঠান:
মার্গারেট লুসাই বলেন, নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লুসাই সমাজে শিশু জন্মগ্রহণের বিষয়টি স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। পরিবারে জন্মের ৩ দিন পর আত্ময়ীস্বজনকে নিমন্ত্রণ দিয়ে ১টি গয়াল বা ১টি শুকর বধ করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বাড়ির সামনে একটি লম্বা পরিপক্ক গাছে সার অংশটি মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। অনুষ্ঠানে লুসাই দম্পতির প্রথম সন্তানের বেলায় পিতৃকুলের পিতামহ-পিতামহী নামকরণ করেন। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে শিশুদের পর্যাপ্ত যত্ন নেয়া হয় লুসাই সমাজে।
আরও পড়ুন : চাক জাতিগোষ্ঠীর বিয়েতে আছে অনেক আনুষ্ঠানিকতা ও বৈচিত্র্য
পোশাক-পরিচ্ছদ:
মার্থা লুসাই বলেন, অতীতে লুসাই সম্প্রদায় পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করতো। পরবর্তীকালে তুলা থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি ‘হ্নখাল’ নামে এক ধরনের চাদর প্রথমে লুসাই পুরুষরা এবং পরে নারীরা ব্যবহার শুরু করে। সময়ের পরিবর্তনে মহিলারা কোমর-তাঁত দিয়ে ‘পুয়ানফেল’ (থামি), ‘করচুং’ প্রভৃতি এবং পুরুষরা ‘করচুর’ (শার্ট) ও পুয়ানবি (লুঙ্গি) তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করে। এছাড়া লুসাই নারীরা বিভিন্ন ধরনের থামি যেমন পুয়ান রৌপুই, পুয়ান চেই, পুয়ানদুম পরিধান করেন। লুসাই নারীরা বিভিন্ন নকশার অলংকার দিয়ে নিজেদের সাজাতে পছন্দ করেন। তারা দামী পাথরের মালা পরেন। অতীতে লুসাই বিবাহ অনুষ্ঠানে বর জামা ও লুঙ্গি এবং কনে ব্লাউজ ও থামি পরলেও বর্তমানে বর শার্ট-প্যান্ট এবং কনে সাদা গাউন পরিধান করে। সময়ের প্রয়োজনে লুসাই সম্প্রদায়ের পোশাক পরিচ্ছদেও এসেছে আধুনিকতা।
ধর্ম:
মার্গারেট লুসাই জানান, লুসাই জনগোষ্ঠী এককালে ভূতপ্রেত, অপদেবতা ইত্যাদি বিশ্বাস করতো। তারা ভূতপ্রেত ও অপদেবতার উদ্দেশে পশু দিয়ে শির পূজা ও নদী পূজা দিত। অতীতে লুসাইরা যার যার গ্রামে একেক নিয়মে দেবদেবীর পূজা করতো। পরে লুসাইদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে শতভাগ লুসাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী।
লোকবিশ্বাস:
উইলিয়াম লুসাই সুখবর ডটকমকে বলেন, লুসাই জনগোষ্ঠীর লোকবিশ্বাস তাদের কারো মৃত্যুর পর মৃতের আত্না ‘মিথিখুয়া’ নামক মৃতপূরীতে বাস করে। মিথিখুয়াতে অবস্থানকালে প্রত্যেকের নিজ নিজ কর্মফলের বিচার হবে। কর্মফল অনুসারেই তারা স্বর্গে যেতে পারবে।
আই.কে.জে/