ছবি: সংগৃহীত
ছেলের ছাগল-কাণ্ডে দেশজুড়ে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমান শেয়ারবাজারে পরিচিত ছিলেন বাজে কোম্পানির ‘প্লেসমেন্ট-শিকারি’ হিসেবে। এই ধরনের কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনতে সহায়তা দিয়ে বিনিময়ে নিতেন প্লেসমেন্ট শেয়ার। পরে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর ওই শেয়ার বিক্রি করে তিনি বড় অঙ্কের মুনাফা তুলে নিতেন।
শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম ও ঢাকাভিত্তিক দুটি ব্রোকারেজ হাউসে নিজের, ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর নামে খোলা পাঁচটি বিও হিসাব থেকে মুনাফা তুলে নিয়েছেন প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। এর বাইরেও মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে ১৫টির বেশি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাঁচটি বিও হিসাব থেকে মুনাফার তথ্য পাওয়া গেলেও বাকিগুলোর মুনাফার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি বিও হিসাবে ৩৬ কোটি টাকা মুনাফার মধ্যে মতিউর রহমান নিজে মুনাফা করেছেন প্রায় ৪ কোটি টাকা, মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ২৩ কোটি টাকা, ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছেন।
আরো পড়ুন: আত্মগোপনে আলোচিত মতিউরের স্ত্রী
মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে ১৫টির বেশি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাঁচটি বিও হিসাব থেকে মুনাফার তথ্য পাওয়া গেলেও বাকিগুলোর মুনাফার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, শেয়ারবাজারে এখন পর্যন্ত এক ডজনের বেশি কোম্পানিতে মতিউর রহমান, তার ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা, প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী, বোন হাওয়া নূর বেগম, ভাই এম এ কাইয়ূম হাওলাদার, নূরুল হুদাসহ তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে।
শেয়ারবাজারে কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে ওই কোম্পানির মালিকরা চাইলে তাদের পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে নতুন শেয়ার ইস্যু করতে পারেন। কাগজ–কলমে এসব শেয়ার বিক্রি করা হয় ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুতে। পরে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির একটি নির্দিষ্ট সময় পর এই প্লেসমেন্ট শেয়ারধারীরা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বেশি দামে বিক্রি করে দেন।
এভাবে মোটা অঙ্কের মুনাফা করে সংঘবদ্ধ একটি প্লেসমেন্ট চক্র। যাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে প্লেসমেন্টে কম দামে শেয়ার কিনে বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলে নেওয়া। এই প্লেসমেন্ট চক্রেরই আলোচিত একটি নাম মতিউর রহমান, যিনি এনবিআরের শীর্ষস্থানীয় পদে ছিলেন।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবসার কোনো সুযোগ নেই। তিনি সেই নিয়মের ব্যত্যয় করেছেন কি না, তা সরকারের খতিয়ে দেখা দরকার। এছাড়া তার (মতিউর রহমান) বিপুল সম্পদ নিয়ে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত করা উচিত।
২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর মানহীন যত কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসেছে, তার বেশির ভাগের প্লেসমেন্ট সুবিধাভোগী ছিলেন মতিউর রহমান। নিজের ও পরিবারের সদস্য এবং নিকটাত্মীয়দের নামে এসব প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনতেন তিনি। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের সময়কালে বাজারে আসা বেশির ভাগ কোম্পানির প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মতিউর রহমান ও তার কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া লোকেরা।
পাঁচটি বিও হিসাবে ৩৬ কোটি টাকা মুনাফার মধ্যে মতিউর রহমান নিজে মুনাফা করেছেন প্রায় ৪ কোটি টাকা, মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ২৩ কোটি টাকা, ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা মুনাফা তুলে নিয়েছেন।
বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের আগে দেশের কোম্পানিগুলোর মূলধন বৃদ্ধিতে বিএসইসির অনুমোদন বাধ্যতামূলক ছিল। মূলধন বৃদ্ধির এই অনুমোদন নিয়েই প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করত কোম্পানিগুলো। ফলে ২০১০ সালের আগে শেয়ারবাজারে ‘প্লেসমেন্ট শেয়ারের’ রমরমা বাণিজ্য গড়ে ওঠে। সেই সময় এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। মতিউর রহমানও এ বাণিজ্যের সুবিধাভোগী একজন।
মতিউর রহমান তার পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের নামে প্লেসমেন্ট ব্যবসা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। এক্ষেত্রে তিনি অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানিগুলোকেই বেছে নেন। অভিযোগ রয়েছে, নিজের পদপদবি ব্যবহার করে ওই সব কোম্পানিকে নানাভাবে সহায়তা দেন শেয়ারবাজারে আসতে। বিনিময়ে তিনি পেতেন ওই কোম্পানির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্লেসমেন্ট শেয়ার।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানিতে মতিউর রহমান, তার পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের নামে প্লেসমেন্ট শেয়ারের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন, এসকে ট্রিমস, মামুন অ্যাগ্রো, লুব-রেফ বাংলাদেশ, ডমিনেজ স্টিল, এক্মি পেস্টিসাইড, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ, অ্যাগ্রো অর্গানিকা, ফরচুন শুজ, রিং সাইন টেক্সটাইল, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, কাট্টলি টেক্সটাইল। এসব কোম্পানিতে মতিউর রহমানের নিজের নামে ৬০ লাখের বেশি শেয়ার ছিল। পরে বাজারে কোম্পানিগুলোর শেয়ারের কয়েক গুণ মূল্যবৃদ্ধির পর তিনি তার হাতে থাকা প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা তুলে নেন।
এইচআ/ আই.কে.জে/