সোমবার, ২০শে অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** পাকিস্তান দেখাল কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হয় *** দেশে লাগাতার অগ্নিকাণ্ডে স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে সরকারের কোর কমিটি *** নাহিদের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বলল জামায়াত *** প্রথম আলোর আলোচনায় জুলাই সনদ *** আলোচনা-সমালোচনায় কবি-সাংবাদিক আলতাফ, সহকর্মীরা প্রতিবাদমুখর, সরব নারীনেত্রীরা *** জামায়াত সম্পর্কে কী এনসিপির নতুন উপলব্ধি *** খালেদা জিয়ার সংসদ নির্বাচনের প্রচারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে যা জানাল বিএনপি *** একের পর এক অগ্নিকাণ্ড নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জরুরি বৈঠক *** জামায়াতসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন কর্মসূচি *** আন্দোলনের জবাবে ট্রাম্প বললেন, ‘আমি রাজা নই’

‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ পাকিস্তানের সঙ্গে ফিরে আসতে হবে, পাকিস্তানি সেনাঘনিষ্ঠ পত্রিকার দাবি

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৮:৩৬ অপরাহ্ন, ১৯শে আগস্ট ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানি সংবাদপত্র দ্য ক্যাচলাইন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ ফিরে পাওয়ার 'স্বপ্ন' দেখছে। পত্রিকাটি বলছে, ৫৪ বছর পর হিসাব-নিকাশের সময় এসেছে। সাবেক ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে পাকিস্তানের সঙ্গে ফিরে আসতে হবে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত দেশটির প্রথম সারির ইংরেজি পত্রিকা দ্য ক্যাচলাইন এক নিবন্ধে তথাকথিত এই 'অভিমত' তুলে ধরেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পাকিস্তানের সঙ্গে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের কথিত 'একীভূত' হওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে পত্রিকাটি।

নিবন্ধটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘দেশদ্রোহী’ বলা হয়েছে। মুজিবের হত্যাকারীদের 'দেশপ্রেমিক' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।  একইসঙ্গে পাকিস্তান প্রেমিক ও পাকিস্তানের নায়ক উপাধিতে ভূষিত করে প্রশংসা করা হয়েছে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও তার ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর। আমান আযমী সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার যোগ্য উল্লেখ করে পত্রিকাটি বলছে, ড. ইউনূসের সরকারের উচিত তাকে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা উভয় পদেই নিয়োগ দেওয়া।

প্রয়াত স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের প্রসঙ্গে পাক সংবাদমাধ্যমটিতে বলা হয়েছে, 'এরশাদ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ভোলেননি।' প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও প্রশংসা করা হয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান 'জামায়াত, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস এবং  মুসলিমদের নেতৃত্বে' অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে পত্রিকাটির দাবি।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, পাকিস্তানি পত্রিকায় নিবন্ধটি এমন এক সময় প্রকাশিত হলো, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ঢাকা-ইসলামাবাদ কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন হাওয়া লেগেছে। শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করছেন। চলতি আগস্ট মাসেই মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের দুই মন্ত্রী। পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ২১শে আগস্ট চার দিনের সফরে ঢাকায় আসবেন। আর দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসবেন ২৩শে আগস্ট। 

পাকিস্তানের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগেভাগে প্রকাশিত নিবন্ধটি দেশটির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাবাসসুম মোয়াজ্জাম খানের লেখা। তাকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ লেখক, কলামিস্ট মনে করা হয়। দ্য ক্যাচলাইনও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রভাবশালীদের সমর্থনপুষ্ট পত্রিকা হিসেবে পরিচিত।

ওই নিবন্ধে লেখা হয়, ১৯৭১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তার চাণক্য-ধাঁচের উপদেষ্টারা মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত 'বিচ্ছিন্নতাবাদীদের' সমর্থন করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জভাবে হস্তক্ষেপ করেন। লক্ষ্য স্পষ্ট ছিল, পূর্ব পাকিস্তানকে মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা। ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ ও প্রচারণার মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয় এবং সেই অংশ পাকিস্তান-বিদ্বেষী বাঙালি হিন্দু এবং তাদের মুসলিম সহযোগীদের হাতে তুলে দিয়েছিল।

অথচ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাঙালি সেনা, ছাত্র ও সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত হয় শক্তিশালী সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিফৌজ। যারা মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাদের হঠাৎ করে 'বিচ্ছিন্নতাবাদীদের' তালিকায় ফেলে দেওয়ার যৌক্তিকতা অবশ্য তুলে ধরেননি ‘দ্য ক্যাচলাইনে’ আলোচ্য নিবন্ধের লেখিকা। 

তিনি পাকিস্তানিদের দেশপ্রেমের কথা বলতে গিয়ে শেখ মুজিবকে 'দেশদ্রোহী' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, গত ৫৪ বছর ধরে যখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর ভারত তাদের তথাকথিত ‘বিজয়’ উদযাপন করেছে, তখনই দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করেছে।

লেখিকার দাবি, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের কুখ্যাত ছবি প্রচার করা হয়েছিল। সেই দিনটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশে’ রূপান্তরিত করা হয়, যা 'দেশদ্রোহী' শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনের অধীনে সম্পন্ন হয়। যিনি তার ভারতীয় প্রভুদের নির্দেশে মুসলিম ও দেশপ্রেমিক পাকিস্তানিদের একপাশে রেখে এই অঞ্চলটিকে হিন্দু আধিপত্যের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।

নিবন্ধে বলা  হয়েছে, একদল 'দেশপ্রেমিক' সেনা কর্মকর্তার হাতে মুজিবের হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন সম্মানিত কমান্ডার জিয়া (হিলাল-ই-জুরাত ভূষিত) পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ এবং ভারতের বিভাজনমূলক প্রভাব মোকাবেলায় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

পাকিস্তানি পত্রিকার ভাষ্য, 'দুঃখজনকভাবে, ১৯৮১ সালে তাকে (জিয়াউর রহমান) হত্যা করা হয়, এরপর ক্ষমতায় আসেন  জেনারেল এইচ এম এরশাদ। তার শাসনামলে, এরশাদ ভারত-সমর্থিত বাঙালি হিন্দু বিদ্রোহীদের প্রতিরোধ করেছিলেন। তবে, বিশ্বাস করা হয় যে তার রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য ভারত তাকে একটি হানিট্র্যাপের ফাঁদে ফেলেছিল। তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছিল।'

পত্রিকাটির দাবি, 'তবুও, এরশাদ পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ভোলেননি। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল, পাকিস্তানের নায়ক এবং জামায়াতের নেতা প্রয়াত গোলাম আযমের পুত্র আব্দুল্লাহিল আমান আযমীর ক্ষেত্রে তার হস্তক্ষেপ।'

পত্রিকাটির দাবি, '১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর পাকিস্তান বিরোধী উপাদান এবং বাঙালি হিন্দুদের বিরোধিতার মুখোমুখি হন আযমী, তারা তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কারণ, তিনি এবং তার বাবা (গোলাম আযম) তখনও পাকিস্তানি নাগরিক ছিলেন। যখন বিষয়টি আরও তীব্র আকার ধারণ করে, তখন গোলাম আযম এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরশাদ সমস্যাটি সুষ্ঠুভাবে সমাধান করেন। আমান আযমী তার বাবার মতো  সবসময়ই  একজন কট্টর দেশপ্রেমিক ছিলেন।'

নিবন্ধে বলা হয়, তিনি (আমান আযমী) একাধিকবার প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সংগীত বা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে স্বীকৃতি দেন না, বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশকে প্রত্যাখ্যান করেন—বিশেষ করে পহেলা বৈশাখের মতো উৎসব আরোপের বিষয়টিকে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্মান রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনী এবং তাদের পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণার নিন্দা করেছেন।

আরো বলা হয়, ১৯৮১ সাল থেকে আযমী  নীরবে নিজের  দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে চলতে থাকেন। ভারতীয় প্রভাব থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধার করা এবং পাকিস্তানের অংশ  পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু ২০০৯ সালের ২৪শে জুন মুজিবের কন্যা এবং ভারতের অন্যতম দাবার ঘুঁটি শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ক্ষমতা গ্রহণের পর ব্রিগেডিয়ার আযমীকে আকস্মিকভাবে সামরিক চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন।

দ্য ক্যাচলাইন বলে, 'এরপর, তার (শেখ হাসিনা) শাসনামলে পরিবারটি (গোলাম আযমের) বছরের পর বছর নির্যাতন সহ্য করে। ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, যা কার্যকরভাবে এটিকে (বাংলাদেশ) নয়াদিল্লির একটি উপগ্রহ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। যাই হোক, ঘটনায় নাটকীয় মোড় আসে। জামায়াত, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং  মুসলিমদের নেতৃত্বে ব্যাপক বিক্ষোভের ফলে হাসিনা গত বছরের ৫ই আগস্ট ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন, যেখানে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়।'

দ্য ক্যাচলাইনের দাবি, বাংলাদেশ ভারতীয় আধিপত্যের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর অধ্যাপক ড. ইউনূস পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন শুরু করেন। ২০২৪ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার আযমীর বিরুদ্ধে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয় এবং তাকে পূর্ণ সুযোগ-সুবিধাসহ অবসর দেওয়া হয়। কিন্তু এটি কোনও প্রকৃত ন্যায়বিচার ছিল না। আযমীর মতো একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি জেনারেল পদে পদোন্নতি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য।

পাক পত্রিকার ভাষ্য, যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ড. ইউনূসের উচিত, তাকে (আমান আযমী) জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা উভয় পদেই নিয়োগ করা- এমন ভূমিকায় তাকে প্রতিষ্ঠিত করা  যেখানে তার কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য তুলনাহীন  হবে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ভারতের  ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পাকিস্তানের  জাতীয় চেতনায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, ১৯৭১ সাল থেকে সেই  ক্ষত বহন করে আসছে দেশের (পাকিস্তান) মানুষ। আজ ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান এবং কৌশলগত গভীরতা পুনরুদ্ধারের জন্য একটি নতুন জানালা খুলে গেছে।

পাক পত্রিকার দাবি, 'আবদুল্লাহিল আমান আযমীর মতো দেশপ্রেমিকদের পুনর্বহাল এবং ক্ষমতায়ন কেবল প্রতীকী নয়- এটি কয়েক দশকের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার  প্রথম পদক্ষেপ। পাকিস্তানকে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, ঢাকার মিত্রদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশনে তার ন্যায্য স্থান পুনরুদ্ধার করা যায়।  এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়, নয়তো ইতিহাস ক্ষমা করবে না।'

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তানি পত্রিকা

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250