ছবি : সংগৃহীত
রবিউল হক
বাউলদের শিরোমনি মানবতার মূর্ত প্রতীক মহাত্মা ফকির লালন শাহ সবসময় তার গানের মধ্যদিয়ে মানবতার ও মানুষের কথা বলে গেছেন। মানুষের মধ্যে যে মানুষ বসবাস করে তাকে চেনার কথা বলে গেছেন। সদা সত্য বলা, সুপথে চলার কথা বলেছেন। নিম্নে ফকির লালন শাহের একটি গান তথা অমর বাণী ও এর প্রজ্ঞাময় ব্যাখ্যা নিয়ে আলোকপাত করা হলো:
“সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন।
সত্য সুপথ না চিনিলে, পাবিনে মানুষের দরশন।।
খরিদ্দার মহাজন যে জন, বাটখারাতে কম,
তারে কসুর করবে যম।
গদিয়ান মহাজন যে জন, বসে কেনে প্রেম রতন।।
পরের দ্রব্য পরের নারী, হরণ করো না,
পাড়ে যেতে পারবে না।
যতোবার করিবে হরণ, ততোবার হবে জনম।
লালন ফকির আসলে মিথ্যে,
ঘুরে বেড়ায় তীর্থে তীর্থে।
সই হলো না এক মন দিতে,
আসলে তে প’লো কম”।।
প্রজ্ঞাময় ব্যাখ্যা: মূলত মানুষের মনের দ্বারাই সুপথ-কুপথ রচিত হয়। মন সদা বস্তুতে বস্তুতে বিরাজ করে। তাই মানুষ সবসময় বস্তুমুখী হয়ে থাকে। লালন শাহ ফকির তাই মনকে সুপথে চলার জন্য আহবান করেছেন। মন যদি বস্তুর ওপরে প্রজ্ঞাবান অবস্থায় না থাকে তবে তার ভাগ্যে প্রজ্ঞাবান মানুষ গুরু পাওয়া সম্ভব নয়।
মন কোনো সময় স্থির থাকে না। এই উদাস মন সর্বদা বস্তুর মধ্যেই বিরাজ করে। মন পরের দ্রব্য বা পরের নারী হরণ করার চিন্তা করায় মত্ত থাকে। পরের নারী বা পরের দ্রব্য চিন্তা করাই হরণ করার সমতুল্য। এই কুচিন্তাই মানুষের বারবার মৃত্যু ঘটায়। বিবেকের দংশন মানুষের মনের মৃত্যুর সমতুল্য। মনকে পরিশুদ্ধ করতে গেলে নিজের দেহ মনই এর জন্য উত্তম স্থান। আবার ওজনে কম দেবার প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে যমের কাছে ঠিকই ধরা পড়তে হবে। এজন্য যারা কম দেয় তাদের কখনোই অভাব দূরীভূত হয় না। কিন্তু খাঁটি মানুষকে খুব বেশি দৌড়ঝাপ করতে হয় না। আর প্রেম রতন বা অনাবিল প্রেমের সুখময় অনুভূতি আপন দেহেই জেগে ওঠে। পরম স্রষ্টাকেও গদিয়ান মহাজন হিসেবে আমরা মনে করতে পারি যিনি বসে থেকে প্রেম রত্ন কেনাবেচা করেন।
আবার লালন সাঁইজি তার গানে বুঝিয়েছেন নিজের দেহ মনের বাইরে কোথাও তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করলেই সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। সত্যকে পেতে হলে একমনে কায়বাক চিত্তে গুরুর নির্দেশনা অনুসরণ করে সাধনার দ্বারা সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কেননা এর মাধ্যমেই মানুষের প্রকৃত মুখ্য লাভ বা মুক্তি ঘটে।
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
এস/ আই.কে.জে/