১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া গণহত্যা সম্পর্কে এখন অনেকেই জ্ঞাত, তারপরেও কি এ গণহত্যার শাস্তি হবে না? হেনরিকাস হ্যারি ভ্যান বোমেল এবং তার সহকর্মীরা এ প্রশ্নের উত্তরের খুঁজেই এসেছিলেন বাংলাদেশে।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা, বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের নৃশংসতা এবং অপরাধের কথাগুলো জানতেই চলতি বছরের ২০-২৬ মে তারা আসেন বাংলাদেশে। তাদের এ সফরের আয়োজক হিসেবে ছিল প্রবাসী সংগঠন ইবিএফ। ইবিএফ এর সহযোগী হিসেবে ছিল আরো কিছু প্রতিষ্ঠান, যেমন, আমরা একাত্তর এবং প্রজন্ম ৭১। সফরকারী এ দলে ছিলেন ডাচ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক এন্থনি হোলস্ল্যাগ, ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন এবং দুইজন বাঙালি মানবাধিকার কর্মী বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া এবং আনসার আহমেদ উল্লাহ।
ইবিএফের সাথে সংযুক্ত স্থানীয় সংস্থাগুলোর শক্তিশালী জনবল রয়েছে। ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের তথ্য খুঁজে পেতে যা যা প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করে। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে সফরকারীদের কথা বলার সুযোগ করেও দেওয়া হয়। তারা চট্টগ্রামের রাউজানে ১৯৭১ সালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী এক বৃদ্ধ মহিলার সাথে কথা বলেন এবং তার কাছ থেকে জানতে পারেন ঐ এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা পুরুষ, মহিলা, ছোট বাচ্চাসহ ৪৩ জনকে হত্যা করে। এত বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দু:সহ স্মৃতি তিনি এখনও ভুলতে পারেন নি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে, বিভিন্ন বধ্যভূমি পরিদর্শন করে এবং নথিপত্র পড়ে সফরকারীরা জানান যে, ১৯৭১ সালে সত্যিই বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এবং এ ঘটনাটি প্রকাশ করার জন্য উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণাদি বাংলাদেশের কাছে রয়েছে।
সফরকারীরা এখন এ রিপোর্ট নিয়ে যাবে ইউরোপ এবং বিশ্বের সকল পার্লামেন্টের কাছে। ডাচ, ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পিটিশনের সাথে অফিসিয়াল রিপোর্ট তারা প্রকাশ করবেন। ২০২৪ সালে নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য দেশে সম্মেলন আয়োজনেরও চিন্তাভাবনা করছেন তারা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং তথ্যচিত্র সবকিছু মিলিয়ে তারা এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। পরবর্তীতে তারা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির চেষ্টাও চালাবে।
তবে নিকৃষ্টতম অপরাধ সংঘটনের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা সত্যিই ভুলার মতো নয়। যদিও এর সাথে ভূ-রাজনৈতিক কারণও জড়িয়ে আছে। সেসময় যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরব ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। স্বাধীনতার চার বছর পরেই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। নতুন সরকার গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তবে আজ এত বছর পরে এসেও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একত্রিত হচ্ছে। গণহত্যার স্বীকৃতির আহ্বান জানিয়ে ইতিমধ্যে দুই কংগ্রেসম্যান মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে দ্বিদলীয় প্রস্তাব পেশ করেন।
গণহত্যা প্রতিরোধ কাজের সাথে জড়িত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলো ২০২১ এবং ২০২২ সালে পৃথক বিবৃতিতে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। হত্যা করা হয় অগণিত মানুষদের। বাড়িঘর, ধর্মীয় উপাসনালয় সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অনেক মানুষ জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেসময় প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, দুই লাখেরও বেশি নারীদের সম্ভ্রম হরণ করা হয় এবং দশ লাখের মতো মানুষ নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো সরকার প্রদত্ত আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গ্রহণের জন্য অনেকেই মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধা সেজে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, অন্যদিকে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাই আজও অবহেলিত হয়ে রয়েছেন। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মাসিক ভাতার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চাকরিতে তাদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছে। ভুক্তভোগী এবং মুক্তিযোদ্ধা উভয়কেই আর্থিক সহায়তাসহ জাতীয় বীরত্ব প্রদান করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন বিদেশী নাগরিককে 'বাংলাদেশের বন্ধু' উপাধি দেওয়া হয় এবং দেশে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সফরকারী দলের সদস্য ক্রিস ব্ল্যাকবার্নকেও এ উপাধি প্রদান করা হয়। তাছাড়া ডাচ-অস্ট্রেলিয়ান উইলিয়াম এ.এস.ওডারল্যান্ডকে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মানসূচক বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। তবে গণহত্যার স্বীকৃতির ব্যাপারে এখনও বাংলাদেশ সরকার তেমন সক্রিয় নয়।
বর্তমান সরকার নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করলেও আজও দেশে ধর্মভিত্তিক হামলা চলে। কিছু ইসলামি দল ধর্মের নামে দেশে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং সহিংসতাকে উসকে দেয়। এই সহিংস চরমপন্থীরা কয়েক বছর আগে ঢাকায় বিপুল সংখ্যক বিদেশি নাগরিকদেরকে হত্যা করে। সরকার সেই সহিংস চরমপন্থীদের আটকাতে সক্ষম হলেও মৌলবাদ বাংলাদেশে চলমান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। মৌলবাদীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী এবং বাংলাদেশকে শরীয়তপন্থী বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে গণহত্যার স্বীকৃতির ব্যাপারে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আরো সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়েই চাপ প্রয়োগ করে এ ঘটনা জাতিসংঘে উত্থাপন করতে হবে।
ভ্যান বোমেল জানান বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিতে, এর ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দিতে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা তিনি করবেন। তাছাড়া তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে গণহত্যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য অথচ উপেক্ষিত অধ্যায় এটি। রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে মানবতাকে সম্মান জানানোর জন্য সবাইকে আহ্বান করেন তিনি।