বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরআনের বিধান কি?

ঘরে ঢুকার সময় কি অনুমতির প্রয়োজন আছে?

ধর্ম ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৫:৫৮ অপরাহ্ন, ৩রা জুন ২০২৩

#

প্রতীকী ছবি

হে মুমিন! ঘরে প্রবেশের আগে অনুমতি নাও। চাই সেটা অন্যের ঘর হোক কিংবা নিজের ঘর। যাতে ঘরের অধিবাসীরা তাদের হালত/অবস্থা পরিচ্ছন্ন বা ঠিকঠাক করতে পারে। এটা ইসলামের সৌন্দর্য। তবে কোরআনুল কারিমে অন্যের ঘরে প্রবেশের আগে অনুমতি চাওয়াকে আবশ্যক করেছেন। কোরআনের এই বিধানটি কী?

অন্যের ঘরে প্রবেশের সময় কি অনুমতির প্রয়োজন?

অন্যের ঘরে প্রবেশ করার আগে অনুমতি চাও আবশ্যক। অনুমতি না নিয়ে কাউকে কিছু না বলে হুট করে কারও ঘরে ঢুকে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে মুমিনদের এভাবে নির্দেশ দিয়েছেন-

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُيُوْتًا غَيْرَ بُيُوْتِكُمْ حَتّٰي تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤي اَهْلِهَا ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ،فَاِنْ لَّمْ تَجِدُوْا فِيْهَاۤ اَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوْهَا حَتّٰي يُؤْذَنَ لَكُمْ وَ اِنْ قِيْلَ لَكُمُ ارْجِعُوْا فَارْجِعُوْا هُوَ اَزْكٰي لَكُمْ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ.

‘হে মুমিনগণ! নিজ ঘর ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না অনুমতি গ্রহণ কর ও তার বাসিন্দাদেরকে সালাম দাও। এ পন্থাই তোমাদের জন্য শ্রেয়। আশা করা যায়, তোমরা লক্ষ্য রাখবে। তোমরা যদি তাতে কাউকে না পাও, তবুও যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হয়, তাতে প্রবেশ করো না। তোমাদেরকে যদি বলা হয়, ‘ফিরে যাও’ তবে ফিরে যেও। এটাই তোমাদের পক্ষে শুদ্ধতর। তোমরা যা কিছুই করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত। (সুরা নুর: আয়াত ২৭-২৮)

কোরআনুল কারিমের এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে অন্যের ঘরে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নেওয়ার এবং সালাম দেওয়ার কথা বলেছেন। অনুমতি না নেওয়া পর্যন্ত ঘরে প্রবেশ করা যাবে না। আর ঘরের লোক যদি অনুমতি না দিয়ে ফিরে যাওয়ার কথা বলে তবে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ অনুমতি ছাড়া অন্যের ঘরে প্রবেশ করলে সেই ঘরের লোকদের নানারকম কষ্ট ও অসুবিধা হতে পারে। এ আয়াতে ইসলামের ফরজ বিধান পর্দা ও সতর লঙ্ঘিত হয়। বিনা অনুমতিতে কারও ঘরে প্রবেশ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার সয়লাবের অন্যতম বড় কারণও বটে।

নিজ ঘরে প্রবেশে সালামের নিয়ম ও ফজিলত

অন্যের ঘরে প্রবেশে যেমন অনুমতির প্রয়েজন হয় তেমনি নিজ ঘরে প্রবেশে অনুমতি না লাগলেও সালাম দেওয়ার দিকনির্দেশনা এসেছে কোরআনে। তাই নিজের ঘরে প্রবেশের আগেও উচ্চ স্বরে সালাম দেওয়া জরুরি। এতে পরিবারের লোকেরা সতর্ক হতে পারবে। এতে ফজিলতও অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَإِذَا دَخَلْتُم بُيُوتًا فَسَلِّمُوا عَلَى أَنفُسِكُمْ تَحِيَّةً مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُبَارَكَةً طَيِّبَةً كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُون

‘এরপর যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ কর, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্রতার দোয়া। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্যে আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ননা করেন, যাতে তোমরা বুঝে নাও।‘ (সুরা নুর: আয়াত ৬১)

কোরআনের এ নির্দেশনার সঙ্গে মিল রেখেই হাদিসে পাকে চমৎকার একটি ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। কেউ সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেই আল্লাহর জিম্মাদারিতে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করবেন। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর জিম্মাদারি তিন ব্যক্তির জন্য। তারা হলেন-

১. যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হয়েছে; সে আল্লাহর জিম্মাদারীতে রয়েছে, যে পর্যন্ত আল্লাহ তাকে উঠিয়ে না নেন এবং জান্নাতে প্রবেশ না করান। অথবা তাকে ফিরিয়ে আনেন, যে সাওয়াব বা যে গনীমাতের মাল সে যুদ্ধে লাভ করেছে তার সাথে।

২. যে ব্যক্তি মসজিদে গমন করেছে সে আল্লাহর দায়িত্বে রয়েছে। এবং

৩. যে ব্যক্তি সালাম দিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করেছে, সে আল্লাহর জিম্মাদারিতে রয়েছে।’ (আবু দাউদ)

অনুমতি নেওয়ার নিয়ম

নিজ ঘরে কিংবা অন্যের ঘরে প্রবেশের আগে কীভাবে অনুমতি নিতে হবে, কোরআনের আয়াতে তা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিয়ম হলো-

>> বাইরে থেকে উচ্চ আওয়াজে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা। শুধু গলা চেঁচিয়ে বা এটা সেটা বলে আওয়াজ না দেওয়া। যদি সন্দেহ হয় যে, সালামের আওয়াজ ঘরের ভেতরে যাবে না বা শুনতে পাবে না তবে দরজায় করাঘাত করবে বা কলিংবেল চাপ দেওযা। তারপর কেউ বেরিয়ে এলে তাকে আগে সালাম দেওয়া। ঘরের মালিক যতক্ষণ পর্যন্ত প্রবেশের অনুমতি না দেবে, ততক্ষণ কারও ঘরে প্রবেশ করা যাবে না।

>> আবার দীর্ঘক্ষণ ধরে করাঘাত করা যাবে না। দুই/তিনবার আওয়াজ দেওয়ার পরেও যদি ঘরের লোকদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া না যায়, তাহলে ফিরে যাওয়া। কিন্তু অনেকের স্বভাব হল, দুই/তিনবার আওয়াজ করার পরে যদি ভেতর থেকে সাড়া না আসে, তাহলে ‘ঘরে কেউ আছে কি না’ জিজ্ঞাসা করতে করতে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায় অথবা উঁকিঝুকি মারতে থাকে। এতে ঘরের লোকদের বাড়তি অসুবিধায় পড়তে হয়। এমনটি করা যাবে না।

>> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এ সংক্রান্ত অনেক ঘটনা রয়েছে। যেখানে তাঁরা কারও ঘরে যাওয়ার পরে উচ্চ স্বরে সালাম দিয়েছেন, জবাব না পেলে তিনবার সালাম দিয়েছেন। তারপরও উত্তর না এলে ফিরে গেছেন। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘরে গিয়ে আবু মুসা আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর সালাম দেওয়া এবং সাদ ইবনে উবাদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘরে গিয়ে নবিজির সালাম দেওয়ার ঘটনা দুটি অনেক প্রসিদ্ধ।

নিজ ঘরের ব্যক্তিগত রুমে যাওয়ার অনুমতি

একই ঘরের লোকদেরও অন্যের ব্যক্তিগত কামরায় প্রবেশের আগে অনুমতি নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রেও সালাম দেওয়া সর্বোত্তম। কোনো রকম সতর্ক না করেই অন্যের রুমে বা ঘরে হুট করে ঢুকে পড়া কিছুতেই উচিত নয়। আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন-

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لِيَسْتَاْذِنْكُمُ الَّذِيْنَ مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ وَ الَّذِيْنَ لَمْ يَبْلُغُوا الْحُلُمَ مِنْكُمْ ثَلٰثَ مَرّٰتٍ مِنْ قَبْلِ صَلٰوةِ الْفَجْرِ وَ حِيْنَ تَضَعُوْنَ ثِيَابَكُمْ مِّنَ الظَّهِيْرَةِ وَ مِنْۢ بَعْدِ صَلٰوةِ الْعِشَآءِ ثَلٰثُ عَوْرٰتٍ لَّكُمْ لَيْسَ عَلَيْكُمْ وَ لَا عَلَيْهِمْ جُنَاحٌۢ بَعْدَهُنَّ طَوّٰفُوْنَ عَلَيْكُمْ بَعْضُكُمْ عَلٰي بَعْضٍ كَذٰلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْاٰيٰتِ وَ اللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ، وَ اِذَا بَلَغَ الْاَطْفَالُ مِنْكُمُ الْحُلُمَ فَلْيَسْتَاْذِنُوْا كَمَا اسْتَاْذَنَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ كَذٰلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ اٰيٰتِهٖ وَ اللهُ عَلِيْمٌ حَكِيْمٌ.

‘হে মুমিনগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীগণ এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখনও সাবালকত্বে পৌঁছেনি সেই শিশুগণ যেন তিনটি সময়ে (তোমাদের কাছে আসার জন্য) অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের নামাজের আগে, দুপুর বেলা যখন তোমরা পোশাক খুলে রাখ এবং ইশার নামাজের পর। এ তিনটি তোমাদের গোপনীয়তা অবলম্বনের সময়। এ ছাড়া অন্য সময়ে তোমাদের ও তাদের প্রতি কোনো কঠোরতা নেই। তোমাদের পরস্পরের মধ্যে তো সার্বক্ষণিক যাতায়াত থাকেই। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের কাছে আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে থাকেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।

আর তোমাদের শিশুরা সাবালকত্বে উপনীত হলে তারাও যেন অনুমতি গ্রহণ করে, যেমন তাদের আগে বয়ঃপ্রাপ্তগণ অনুমতি গ্রহণ করে আসছে। এভাবেই আল্লাহ নিজ আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে থাকেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সুরা নুর: ৫৮-৫৯)

আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমের এ আয়াতে নাবালক কিন্তু বুঝদার শিশুদের অনুমতির জন্যও তিনটি সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সাধারণত এ সময়গুলোতে মানুষের পোশাক পরিপাটি থাকে না। আর নাবালক ছাড়া অন্যদের জন্য কোনো সময় নির্ধারণ করেননি। অর্থাৎ তারা যখনই অন্যের কামরায় প্রবেশ করবে, তখনই অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে। এক্ষেত্রে শিথিলতা ইসলামি শিষ্টাচার বহিভূর্ত। ঘরের ছোট-বড় সকল সন্তানকে তাদের পরস্পরের ও মা-বাবার ঘরে প্রবেশের এ ইসলামি আদব শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

মনে রাখতে হবে

নিজের মা-বাবার কামরায় প্রবেশ করার সময় অনুমতি নেওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয়। অথচ কোরআনুল কারিমে সন্তানের ব্যাপারেই বলা হয়েছে, তারা যেন মা-বাবার ঘরে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে। হাদিসে পাকে এসেছে-

এক সাহাবি নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আমার মায়ের ঘরে প্রবেশের সময়ও কি অনুমতি নেব? নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি তাকে উলঙ্গ দেখতে পছন্দ করবে? তিনি বললেন, না। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাহলে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করো। (মারাসিলে আবু দাউদ ৩৩৬)

আরো পড়ুন: সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা জরুরি যে কারণে

আল্লাহ তা'আলা মুসলিম উম্মাহর সবাইকে নিজ ঘর হোক কিংবা অন্যের ঘর হোক অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এম এইচ ডি/

আল্লাহ তা'আলা মুসলিম উম্মাহ ইসলাম হাদিস উপদেশ কোরআনের বিধান নবিজি সাহাবী

খবরটি শেয়ার করুন