সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তিস্তা নিয়ে ভারতের এই রাজনীতি আর কতদিন!

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৪:৩৫ অপরাহ্ন, ২২শে জুন ২০২৩

#

তিস্তা ব্যারেজের একাংশ (ফাইল ছবি)

অভিন্ন নদী তিস্তার উজানে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহারই শুধু নয়, বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণের পানি ছেড়ে দিচ্ছে ভারত। প্রতি বছর এভাবে ১০-১২ বার হুটহাট পানি ছেড়ে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলকে বিপদাপন্ন করে তুলছে দেশটি। কিন্তু পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি এবং সেই পানি ছেড়ে দেয়ার আগাম খবরটুকুও বাংলাদেশকে জানাচ্ছে না তারা। ফলে আচমকা বন্যায় সর্বস্ব হারাচ্ছে উত্তর জনপদের মানুষ। কিন্তু ভারতের এই রাজনীতি আর কতদিন চলবে?

দুই দেশের মধ্যে একটি যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) থাকলেও তথ্যের আদান-প্রদান নেই দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। এ কারণে ভারতের বৃষ্টিপাত বিশ্লেষণ করে ঢল-বন্যার ধারণার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

২০২১ সালের ২০ অক্টোবর। বাংলাদেশের জলবায়ু অনুযায়ী ওই সময়টি শুষ্ককাল। এদিন এক রাতের আকস্মিক বন্যায় বিলীন হয়ে যায় তিস্তা তীরবর্তী গ্রামের পর গ্রাম। আগে থেকে সেই ঢলের খবর জানতে না পারায় ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, গোলার ধান-চাল, গবাদিপশু কিছুই রক্ষা করার সুযোগ পায়নি তিস্তা পাড়ের মানুষ। এতে বিশেষ করে তিস্তা ব্যারেজের ভাটিতে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও হাতিবান্ধা এবং রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কয়েক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ওই বছর সাড়ে পাঁচ লাখ কিউসেক পানি নিঃসরণ ক্ষমতাসম্পন্ন গজলডোবা ব্যারেজের ৫৪টি গেটের সব কটি খুলে দেয় ভারত। এতে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে সাড়ে চার লাখ নিঃসরণ ক্ষমতার তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেটের সব খুলে দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি বাংলাদেশের। ব্যারেজের উজানে পানি ফুলে-ফেঁপে ওঠে। নিঃসরণ ক্ষমতার চেয়ে প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ কিউসেক পানি বেশি আসতে থাকায় দোয়ানীতে ব্যারেজের ফ্লাডফিউজ খুলে গিয়ে ফ্লাড বাইপাস বিধ্বস্ত হয়। প্রবল বেগে ফ্লাড ডাইকের একটি অংশ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে।

সে বারের ফ্লাড বাইপাস বিধ্বস্ত হওয়ার অনেক ক্ষত এখনও শুকায়নি। বিধ্বস্ত ফ্লাড বাইপাসসহ ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো এখনও মোরামত করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাড বাইপাস পুনর্নির্মাণের টেন্ডার আহ্বান করলে কাজটি পান সরকারদলীয় প্রভাবশালী এক ঠিকাদার। কোন রকমে কিছু কাজ করার পর মোটা অংকের বিল তুলে অবশিষ্ট কাজ ফেলে রেখেছেন। ফলে নড়বড়ে ওই অবকাঠামোর ওপর আবারও চাপ ফেলছে ঢলের পানি।

২০২১ সালে তৃতীয়বারের মতো আচমকা ঢলের তোড়ে ফ্লাড বাইপাসটি বিধ্বস্ত হয়। যার আগাম কোনও খবর ছিল না পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। হু হু করে পানি বাড়তে থাকায় দ্রুত মাইকিং করে তিস্তা ব্যারেজ ও আশপাশে বসবাসকারী লোকজনদের সরিয়ে নেয়ার বন্দোবস্ত করে লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলা প্রশাসন ও পুলিশ। ওই বছর পাঁচটি জেলার ১২টি উপজেলার লক্ষাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতির মুখে পড়ে আমন আবাদও।

এখনও পাহাড়ি ঢল বা নদীর পানি বৃদ্ধির আগাম খবর জানতে পারে না তিস্তাপাড়ের মানুষ। এখনও শুষ্ক মৌসুমে ফসলহানি আর ঢল-বন্যার আশঙ্কায় তাদের কাটে পুরো বর্ষাকাল।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান ২০২১ সালের ২০ অক্টোবরের ওই বন্যার কথা স্মরণ করে বলেন, সে বারের একদিনের বন্যায় তিস্তাপাড়ের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও সামলে উঠতে পারেনি এ জনপদ।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন অস্থায়ী একটি চুক্তির ভিত্তিতে গজলডোবা ব্যারেজ থেকে ভারত রেডিওলিংকের মাধ্যমে এক সময় বাংলাদেশকে বন্যার আগাম খবর জানাতো। কিন্তু দুই যুগ ধরে তারা আর এ খবর জানাচ্ছে না বাংলাদেশকে। ফলে ঠিক কখন নদীর পানি বাড়বে বা কখন কমবে, কতটুকু বাড়বে বা কমবে তা আগে থেকে জানতে পারছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তা নদীর ভারতীয় অংশের বৃষ্টিপাতের খবর বিশ্লেষণ করে শ্রেফ ধারণার ওপর ভর করে থাকতে হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে।

তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হাক্কানী বলেন, প্রতি বছর ১০-১২ বার হড়কা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। কেবলমাত্র শক্তিমত্তার জোরে তিস্তা নদীর পানি নিয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলছে ভারত। অভিন্ন নদীর পানির আগাম খবর বা পূর্বাভাস আমাদের না জানিয়ে তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে আমাদের।

হিমালয় থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীতে সাড়ে চার লাখ কিউসেক পানি নিঃসরণ ক্ষমতার তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্প বাংলাদেশ নির্মাণ করে লালমনিরহাটের দোয়ানীতে। এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার জন্য ১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিক অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ।

আরো পড়ুন: বেড়েছে তিস্তার পানি, খুলে দেওয়া হয়েছে ৪৪ গেট

কিন্তু এর আগেই বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের ঠিক ৭২ কিলোমিটার উজানে ভারত সাড়ে পাঁচ লাখ কিউসেক পানি নিঃসরণ ক্ষমতার গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণ করে একতরফাভাবে অভিন্ন এ নদীর পানি প্রত্যাহার করে তাদের ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সম্প্রসারণ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশকে না জানিয়ে এ সেচ কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণের জন্য নতুন করে আরও দুটি খাল খননের কাজ শুরু করেছে উজানের এ দেশটি।

এম এইচ ডি/ আই. কে. জে/ 

তিস্তা নদী ভারত রাজনীতি

খবরটি শেয়ার করুন