বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুরন্ত শৈশব বনাম ভার্চুয়াল শৈশব 

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৬:৫৭ অপরাহ্ন, ১৬ই মে ২০২৩

#

শৈশবের দুরন্ত খেলা

মোহাম্মদ মাসুদ খান

আবহমান কাল থেকে আমাদের চিরায়ত বাংলার ছেলেমেয়েরা খেলতো গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, এক্কা-দোক্কা, কানামাছি, ইচিংবিচিং, বৌছি, কুত-কুত ইত্যাদি নানান খেলা। দুরন্ত কিশোররা খেলতো ডাংগুলি আর মার্বেল।

গত দুই-তিন দশক ধরে এই খেলাগুলোকে আর দেখা যায় না। শহরতো দূরের কথা অজপাড়া গাঁয়েও এসব খেলা কাউকে খেলতে দেখা যায় না। অথচ সাশ্রয়ী এই খেলাগুলো শিশুদের শারীরিক বিকাশে দারুণ সহায়ক ছিল।

এই খেলাগুলো ছাড়াও অন্যান্য জনপ্রিয় খেলা হাডুডু (কাবাডি), ভলিবল, হকি এমনকি সত্তর-আশি দশকের জনপ্রিয় খেলা ফুটবলও এখন নিয়মিত মাঠে গড়ায় না। আমাদের খেলাগুলোর এমন বেহাল দশা দেখে কালজয়ী শিল্পী মান্নাদে’র গাওয়া একটি বিখ্যাত গানের কলি মনে পড়ে যায়।

“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই” এ গানটিকে প্যারোডি করে তাই গাইতে ইচ্ছে করে, ‘মাঠ-ঘাটের খেলাগুলো আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেলো মাঠ-ঘাটের খেলাগুলো আজ আর নেই।’  
হাডুডু ভারতে, গলফ আজ ঢাকাতে।

নেই তারা আজ কোনো খবরে,

ফুটবল, হকি আর ভলিবল

ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে।

ক্রিকেট টাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে শুনেছিতো মিলিয়ন ডলার বোর্ড তার, শিরোপা আর ট্রফিতে আগা গোড়া মোড়া সে অফিস কোচ সব কিছু দামি তার।

মান্না দের গাওয়া বিখ্যাত “কফি হাউজের সেই আড্ডাটা” গানটি কে ব্যাঙ্গ করা আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। মূলত আমার লেখার উদ্দেশ্য অবহেলিত ও হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলোকে পুনরায় মাঠে ফিরিয়ে আনা।

সময়ের পথপরিক্রমায় বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আজ বিলীনের পথে। গত দুই-তিন দশক ধরে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে বটে।

আমাদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস এমনকি ঘরে ঘরে দেখা মেলে ডেস্কটপ পিসি আর ল্যপটপ। সবার হাতে স্মার্ট ফোনতো রয়েছেই। শিশু কিশোরদের কাছেও পোঁছে গেছে আজ এসব ইলেক্ট্রনিক গেজেট। তাদের কারো কারো হাতে শোভা পায় ট্যাব আর আইপ্যাড।   

এই গেজেটগুলোর সাহায্যে আমরা যতটা না প্রয়োজনীয় কাজ করি তার চেয়ে ঢের বেশি করি অপ্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড। ছেলে বুড়ো-নারী-পুরুষ নির্বিশেষ বুদ হয়ে থাকি সোস্যাল মিডিয়ার জগতে।  আর এর কবল থেকে আমাদের কোমলমতি শিশু কিশোররাও বাদ যাবে কেন? বরং তারা আরো এক ধাপ এগিয়ে।

ফুটবল-ক্রিকেট এখন আর মাঠে খেলার প্রয়োজন হয় না, তা খেলার জন্য ওদের কাছে ছয় ইঞ্চি স্ক্রীনই যথেষ্ট। এতে ছেলেমেয়েদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ না হলেও বাবা-মা এতেই খুশি। তাদেরকে বাসায় বন্দী রাখতে পেরে আমরা অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।

দীর্ঘক্ষণ গেমসে ডুবে থেকে এসব ছেলেমেয়েদের অনেকেই সবার অগোচরে অসামাজিক হয়ে পড়ছে। কেউবা হচ্ছে মানসিকভাবে অসুস্থ। দীর্ঘসময় গেমসে নিমজ্জিত অনেক শিশু-কিশোর ভুগছে দৃষ্টিশক্তি সমস্যায়।  ফলে আমরা পাচ্ছি চশমাধারী নতুন এক প্রজন্ম। যাদের গণ্ডি কেবল বাসা থেকে স্কুল আবার কখনোবা রেস্টুরেন্টে ফাস্ট ফুড খেতে যাওয়া পর্যন্ত।   

এই শিশু-কিশোরদের কেউ কেউ আরো এগিয়ে। তারা ডুবে থাকে PUBG, Clash of Clans, Mine craft, World of war craft, Fortnite, League of legends, Roblox এর মতো online গেমসের জগতে। অতিমাত্রায় গেমসগুলো  খেলতে খেলতে কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েরা এক সময় গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ে । পড়া-লেখায় হয়ে পড়ে অমনোযোগী, আহার-নিদ্রায় থাকে না কোনো নিয়ম যা কেবল মাদকাসক্তদের সাথেই তুলনীয়।    

প্রযুক্তির যুগে যেখানে আমরা অগ্রসর হবো সেখানে আমরা হচ্ছি পশ্চাৎপদ।  কেন আমাদের আজ এই বেহাল দশা? তা নিয়ে কি আমরা ভাবছি?

তিন-চার দশক আগে ছেলে-মেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে মাঠে নামতো। তখন তারা নানান খেলা-ধুলায় মত্ত থাকতো। গ্রামীণ ছেলে-মেয়েরা গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, হাডুডু, ভলিবল, ফুটবল ইত্যাদি খেলতো। পুকুর-খাল-বিল-নদীতে সাতার কাটতো।

শহরের ছেলেমেয়েরাও কম-বেশী একই রকম খেলাধুলা করতো। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ছাড়াও বাকী খেলাগুলোর সাথে যুক্ত হতো। গত দুই দশক অর্থাৎ ২০০০ সালের পর থেকে মাঠের খেলাধুলা নেই বললেই চলে, যা আছে তা কেবল প্রচার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ।  

সত্তর থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত আমরা থাকতাম রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায়। তখন আমাদের চারপাশে ছিল অসংখ্য খেলার মাঠ, উন্মুক্ত জায়গা ও পুকুর। যেখানে শিশু কিশোররা দাপিয়ে বেড়াতো।   

আমাদের কলোনির মাঝে ছিল পার্ক, লাল মাঠ, কৃষি কলেজের মাঠ। এছাড়াও ছিল পঙ্গু হাসপাতাল ও গার্লস স্কুলের মাঝে উন্মুক্ত মাঠ, জিয়া-চন্দ্রিমা উদ্যান ও কৃষি কলেজের মাঝে বিশাল খোলা প্রান্তর, তেজাগাঁও বিমান বন্দর রানওয়ের পশ্চিমে সুবিশাল খোলা জায়গা। নিউমার্কেট যাবার পথে চোখে পড়তো কলাবাগান ও ধানমন্ডি মাঠ। আরো ছিল কৃষি কলেজের শান্তি পুকুর, ধানমন্ডি লেক, ক্রিসেন্ট লেক, সংসদ লেক যা এখন আর উন্মুক্ত নেই। সেই স্থানগুলো এখন সংরক্ষিত। উন্মুক্ত জায়গাগুলোতে কোথাও গড়ে ওঠেছে বিভিন্ন দপ্তর কিংবা কোথাওবা তৈরি হয়েছে সড়ক পথ।

গত দুই দশক ধরে বৃহত্তর মিরপুর এলাকায় থাকি। শেওড়াপাড়া-কাজীপাড়া এলাকায় কোনো মাঠ দেখা যায় না। পল্লবীতে রয়েছে সিটি ক্লাব মাঠ আর হারুন মোল্লাহ ঈদ্গাহ মাঠ। সিটি ক্লাব মাঠ আবার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। আমার বর্তমান বাসার কাছে রূপনগর আরামবাগ আবাসিক এলাকায় রয়েছে ছোট একটি মাঠ যা ঐ এলাকার সকল ছেলেমেয়েদের জন্য যথেষ্ট নয়। এহেন অবস্থায় কোমলমতি শিশুকিশোরদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সমীচীন নয়।

তাদের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে পর্যাপ্ত মাঠ। সংরক্ষিত মাঠগুলো শিশু-কিশোরদের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। শারীরিক ও মানসিক বিকাশে তাদেরকে মাঠমুখী করাতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে মাটি ও মানুষের খেলাগুলোকে। লক করতে হবে মোবাইল–ট্যাবের ক্ষতিকর গেমসগুলো। নচেৎ ভবিষ্যৎ নিকষ কালো
অন্ধকার।

লেখক- সাধারণ সম্পাদক, শেরে বাংলা নগর গভঃ বয়েজ হাই স্কুল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।

Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন