সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঙালি মুসলিম নারীদের পর্দাপ্রথা

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৩:১১ অপরাহ্ন, ৩০শে জুলাই ২০২৩

#

বরোদায় অভিজাত রাজপুত নারীদের জন্য জেনানা ক্যারিজ, ১৮৯৫। ছবি : ব্রিটিশ লাইব্রেরি

বেগম শায়েস্তা এস একরামুল্লাহ তার আত্মজীবনীমূলক রচনা From Purdah to Parliament (পর্দা থেকে সংসদ) গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়ে স্বীয় জন্মস্থান মাতুলালয়ের বর্ণনা দিয়েছিলেন। কলকাতার সম্ভ্রান্ত মুসলিম অভিজাত নানা সৈয়দ মাহমুদের বাড়িটিকে তিনি চিত্রায়িত করেছিলেন নিম্নোক্তভাবে:

কলকাতায় আমার নানার বাড়িতে আমার জন্ম। একটি পুরাতন, সেকেলে বাড়ি। উনিশ শতকে মুসলিম স্থাপত্যধারায় নির্মিত বাড়িটি। একটি ক্ষুদ্র গেট দিয়ে ঢুকে দীর্ঘ হলঘরে বা বারান্দায় প্রবেশ করতে হতো—তারপর আরো একটি বারান্দা। এর মুখে একটি অঙ্গন বা আঙ্গিনার চতুর্পার্শ্বে বসবাসের ঘর। ঘরসংলগ্ন আরো বারান্দা। এই বারান্দাগুলোই ছিল আমাদের মেয়েদের আড্ডা, অতিথি আপ্যায়ন, বিনোদন ও অবসরের জায়গা। ওপরের ঘরগুলোর জানালা সর্বদা বন্ধ থাকত, পাছে রাস্তা থেকে মেয়েদের দেখা যায়। (সোনিয়া নিশাত আমিন, বাঙালি মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, ২০০২, পৃষ্ঠা: ৪৩)।

বাংলাদেশের নারীর ইতিহাসবিষয়ক গবেষণার অগ্রপথিক মান্যবর অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিনের ‘The World of Muslim Women in Colonial Bengal, 1876-1939’ পিএইচডি অভিসন্দর্ভটি বাঙালি মুসলমান নারীদের সত্তা পরিচয়, অন্দরমহল, আধুনিকতার পথে অগ্রসরতার বিবরণের অনবদ্য সংকলন। গ্রন্থটিরই বাংলা ভাষ্য থেকে ওপরের অনুবাদটুকু নেয়া হয়েছে। আড্ডা, আনন্দ, অবসর উদযাপন কিংবা অতিথি আপ্যায়নে সৈয়দ মাহমুদের পরিবারের মেয়েদের স্বাধীনতা কেবল অন্দরমহলে; কাঠামোগতভাবেই দোতলার জানালা অবরুদ্ধ করে পরিবারের নারীদের পর্দা রক্ষার প্রথা উনিশ-বিশ শতকের একাধিক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রপথিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বাল্যস্মৃতির কিয়দংশ পাঠকের দরবারে তুলতে চাই:

সবেমাত্র পাঁচ বৎসর হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দা করিতে হইত। ছাই কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারো সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দা করিতে হইত। পুরুষদের তো অন্তঃপুরে যাইতে নিষেধ, সুতরাং তাহাদের অত্যাচার আমাকে সহিতে হয় নাই। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪)।

উনিশ শতকের শেষ দুই দশকে রংপুরের পায়রাবন্দের জমিদার প্রাসাদের এই চিত্র আর পরবর্তী শতকের শহর কলকাতার সৈয়দ মাহমুদের বাড়ির দোতলার জানালা বন্ধ রাখার উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন—বাড়ির রমণীকুলের পর্দা রক্ষা করা। ইতিহাসবিদ সোনিয়া নিশাত আমিনের ধ্রুপদি গবেষণা অন্দরমহলের পর্দার (Veil) আড়াল থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এবং আধুনিক নারী হয়ে ওঠার অনবদ্য ইতিহাস গ্রন্থিত হয়েছে। এ গবেষণার প্রতি পাঠকের নজর এনে আমি পঞ্চদশ-অষ্টাদশ কালপর্বের বাঙালি মুসলিম নারীর পোশাক ও পর্দাবিষয়ক কতিপয় খণ্ডচিত্র পরবর্তী অংশে তুলে ধরতে চাই।   

আঠারো শতকের মাঝামাঝি বাংলার অভিজাত মুসলিম রমণীদের পর্দার তথ্য পাওয়া যায় লেখক গোলাম হোসেন তাবাতাবায়ীর সিয়ার-উল-মুতাখ্‌খিরিন গ্রন্থে। গোলাম হোসেনের ভাষ্যমতে, নবাবের মা আমিনা বেগম পর্দার আড়ালে বসবাস করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু প্রাণপ্রিয় সন্তানের মৃত্যু ও মরদেহকে রাজপথে জনপ্রদর্শনের সংবাদ পেয়ে তিনি অত্যন্ত দুঃখিত হন। শোকে কাতর মা আমিনা অবগুণ্ঠনের কথা ভুলে গিয়ে প্রাসাদের বাইরে এসে ছেলের মরদেহকে জড়িয়ে ধরেন। ষোল শতকের শুরুর দিকে পর্তুগিজ ব্যবসায়ী দুয়ার্তো বারবোসা ভারতবর্ষের বহু অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। বারবোসা ‘বাংলা’ নামক রাজ্যের ‘বেংগালা’ শহরের ব্যবসায়িক পণ্যাদি, স্থানীয়দের পোশাক-খাদ্যাভ্যাস, আচার প্রভৃতি বিষয়ে তার অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ নগরের মুসলিম নারীদের সম্পর্কে তার বক্তব্যগুলো ছিল:

এই শহরের সম্ভ্রান্ত মুররা বিলাসী লোক। এদের বাড়িতে বড় বড় পুকুর আছে, তাতে বারবার স্নান করে। এদের অনেক চাকর থাকে। প্রত্যেকের তিন চারটি স্ত্রী আছে। তাদের (স্ত্রীদের) এরা একেবারে আবদ্ধ করে রাখে, খুব দামি পোশাক পরায় এবং রেশম ও রত্নখচিত স্বর্ণালংকার দিয়ে সাজিয়ে রাখে। (বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৫৭৬, সুখময় মুখোপাধ্যায়, ২০০৫, পৃ. ৬৩১)।

বারবোসার প্রায় এক শতক আগে বাংলার রাজদরবারে চৈনিক সম্রাটদের একাধিক কূটনৈতিক মিশন এসেছিল। তাদের মধ্যে ফেইসিনের বিবরণ থেকে তৎকালীন রাজদরবার, দরবারি রীতিনীতি, সমকালীন পোশাক, কৃষিজ পণ্যসহ নানাবিধ তথ্যাদি পাওয়া যায়। বাংলার নারীদের পোশাকের বিবরণে ফেইসিন লিখেছিলেন:

মেয়েরা খাটো জামা পরে, তার চারদিকে সুতি, রেশম বা কিংখাবের ওড়না জড়ায়। (প্রাগুক্ত, পৃ. ৬১৮)

ফেইসিনের বক্তব্যের সমর্থন মেলে চৈনিক সূত্রাদিতে পাওয়া নানা রকমের কাপড়ের মধ্যে।

আরো পড়ুন: মক্কার ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে দেখছেন হজযাত্রীরা

ওপরের দৃষ্টান্তগুলো কেবল শাসক, অভিজাত ও নগরে বসবাসরত মুসলিম রমণীর পোশাক ও পর্দার খণ্ডচিত্র মাত্র। একপেশে বিবরণ বললেও ভুল হবে না। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে মুসলিম নারীদের বিবরণ, স্বয়ম্বরা প্রথা গ্রহণ, বিদ্যাচর্চা ও কাব্য রচনায় পর্দার তথ্য গবেষক মহলে সুবিদিত। অন্দরমহলের বাইরে বাঙালি মুসলমান রমণীর উপস্থিতি হয়তো চৈনিক কূটনৈতিক কিংবা বন্দর-নগরে পরিভ্রমণরত বারবোসার দৃষ্টিগোচর হয়নি।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১. সোনিয়া নিশাত আমিন, বাঙালি মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, ১৮৭৬-১৯৩৯, (পাপড়ীন নাহার অনূদিত), বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০২

২. মমতাজুর রহমান তরফদার, হোসেন শাহী আমলে বাংলা ১৪৯৪-১৫৩৮ (মোকাদ্দেসুর রহমান অনূদিত), ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০১।

৩. সুখময় মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস ১২০৪-১৫৭৬, ঢাকা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, প্রথম প্রকাশ ২০০০, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৫।

৪. এমএ রহিম, বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ১ম ও ২য় খণ্ড (মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান অনূদিত), ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮২।

শহিদুল হাসান: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

sahidul.sajal@yahoo.com

এম এইচ ডি/ আইকেজে 

বাঙালি মুসলিম নারী পর্দাপ্রথা

খবরটি শেয়ার করুন