ছবি: অ্যাপল
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ডেভেলপারস (ডব্লিউডব্লিউডিসি) সম্মেলনে অ্যাপল বহুল প্রতীক্ষিত ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট ভিশন প্রো বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। প্রযুক্তি বিশ্ব এখন এই ডিভাইসের ব্যবচ্ছেদে ব্যস্ত। হেডসেটটিকে অ্যাপল পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ‘স্পেইশাল কম্পিউটার’ হিসেবে।
সবাই জানেন পৃথিবীর গণমানুষ এখনো এই ধরনের হেডসেটের জন্য প্রস্তুত নয়। অ্যাপলও খুব ভালো করেই সেটি জানে। তারপরও তারা এমন একটি পণ্য নিয়ে এসেছে, যেখানে মানুষ ভবিষ্যতের ছোঁয়া পাবে। ডিভাইসটি হয়তো সময়ের তুলনায় অগ্রগামী। তবে প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি করা মেটার ভিআর হেডসেট কোয়েস্ট এবং এখন অ্যাপলের ভিশন প্রো থেকে আন্দাজ করা যায়, ভবিষ্যত কোন দিকে যাচ্ছে।
ভিআর হেডসেটের যে মৌলিক ধারণা, তার ওপর ভিত্তি করেই অ্যাপল তাদের ভিশন প্রো ডিভাইসটি তৈরি করেছে। গত ৫ জুন উন্মুক্ত করার পর প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের রিভিউ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এর আগে এত উন্নত, চমকপ্রদ এবং এতটা জাদুকরী ভিআর হেডসেট আর কেউ তৈরি করেনি।
ভিশন প্রো তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে ব্যবহারকারীরা পছন্দমতো পরিবেশে ভিডিও দেখতে পারে, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফেস টাইমিং করতে পারেন কিংবা ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক কাজ সম্পন্ন করতে পারে।
হেডসেটটিকে অ্যাপল পরিচয় করিয়ে দিয়েছে 'স্পেইশাল কম্পিউটার' হিসেবে। তবে এই ডিভাইসটির ব্যবহার ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার অভিজ্ঞতা তৈরি করবে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
ধরুন সালটি ২০২৫। আপনি আপনার স্বামীর সঙ্গে সোফায় বসে আছেন। যখনই স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন, তখনই শুধু আপনি তাকে দেখতে পান, মানে তিনি আপনার দৃষ্টিসীমায় আসেন। আপনারা যখন কথা বলেন না, তখন আপনার স্বামীকেও দেখতে পান না। ফলে আপনি আপনার সামনে থাকা স্ক্রিনের দিকে আরও মনোযোগ দিতে পারেন। আপনি হয়তো কোনো প্রেজেন্টেশন তৈরি করছেন, দূরে থাকা পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে ফেস টাইমিং করছেন, নতুন কোনো ভাষা শিখছেন কিংবা ইউটিউব দেখে দেখে নতুন কোনো রান্নার রেসিপি শিখছেন।
এমন সময় হয়তো একটি নোটিফিকেশন পেলেন, আপনার ইয়োগা করার সময় হয়েছে। আপনার সামনের স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেছে, যাতে আপনি ইয়োগায় পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন। যখন ইয়োগা শেষ হবে তখন আবারও স্ক্রিন আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। হয়তো আবারও ফেস টাইমিংয়ে যোগ দিলেন। দেখলেন আপনার মা হয়তো মজার কিছু বলছে। আপনি নিশ্চিত নন যে, তিনি কী বলছেন, কিন্তু আপনার অ্যাভাটার ঠিকই হেসে চলেছে।
ভিশন প্রো হেডসেটের সাহায্যে ভবিষ্যতে মানুষ আসলেই এমন বাস্তবতায় বসবাস করবে কি না, তা অবশ্য অ্যাপল নিশ্চিত করেনি। তবে এই ডিভাইসটি বাজারে আনার ঘোষণা দেওয়ার সময় অ্যাপল যে ভিজ্যুয়াল বর্ণনা দিয়েছে এবং এই ধরনের ভিআর হেডসেটের যে সম্ভাবনা, তাতে ভবিষ্যত বাস্তবতা হয়তো উপরে উল্লিখিত বর্ণনার তুলনায় খুব ভিন্ন হবে না।
ভিশন প্রো হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ ডলার দামি একটি স্ক্রিন। একজন ব্যবহারকারী যখন এরকম একটি স্ক্রিন চোখের সঙ্গে লাগাবেন, তখন তিনি পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। হয়তো ভবিষ্যতে আইফোনের স্থলাভিষিক্ত হবে এই ডিভাইস। হয়তো ডিভাইসটি নতুন একটি ইউটোপিয়া আমাদের সামনে হাজির করবে, যেখানে আমরা আমাদের ইচ্ছামতো আশেপাশের পরিবেশ তৈরি করতে পারব। কৃত্রিমভাবে নিজের পছন্দমতো পরিবেশ তৈরি করতে পারব। হয়তো নিজের বাড়িতে আরামের মধ্যে থেকেও নিজেকে বোকাভাবে উপস্থাপনের এটি একটি ব্যয়বহুল উপায়।
অনেকগুলো 'হয়তো' বলা হলেও একটা ব্যাপার মোটামুটি নিশ্চত করে বলা যায়- এটি মানুষকে চরম নিঃসঙ্গ করে তুলবে।
ইন্টারনেটজুড়ে গত কয়েকদিন ধরে ভিশন প্রো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সে থেকে হয়তো ডিভাইসটি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা অনেকেরই হয়েছে। তারপরও এর মৌলিক ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করা যাক-
ভিশন প্রো হচ্ছে একটি অত্যাধুনিক গগলস। এটি মূলত চশমার মতো চোখে পরতে হয়। তবে চশমা যেভাবে কানের সঙ্গে আটকে থাকে, এই ডিভাইসটি মাথায় পরা একটি ব্যান্ডের মাধ্যমে চেহারার সঙ্গে লেগে থাকবে। এটি মূলত একটি ভিআর হেডসেট, যদিও এটিকে ভিআর হেডসেট বলাতে অ্যাপলের আপত্তি আছে। হেডসেটটির বাইরের দিকে একাধিক ক্যামেরা আছে, যার মাধ্যমে এটি বাইরের জগত দেখতে ও বুঝতে পারে। বাইরের ক্যামেরার এই দৃষ্টিসীমা আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। তবে হেডসেটটি নিঝেও পরিস্থিতি বুঝে কাজ করবে। যখন এটি দেখবে আপনি কারও সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলছেন, তখন ক্যামেরার মাধ্যমে তার ছবি আপনাকে দেখবে। আপনি তা দেখতে পাবেন হেডসেটের ভেতরের দিকে থাকা গগলসের মাধ্যমে। আপনি যখন সিনেমা দেখতে চাইবেন, তখন হেডসেটটি আপনার চারপাশে থাকা বাস্তব পরিবেশ বাদ দিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যাতে আপনার সিনেমা দেখাটা আরও উপভোগ্য হয়। আপনি অবশ নিজেও পছন্দমতো পরিবেশ তৈরি করতে পারবেন।
অ্যাপল খুব জোরের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে হেডসেটটি পরিহিত থাকা অবস্থায়ও আমরা বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারব। কোম্পানিটি ভিশন প্রো'র অগমেন্টেড রিয়েলিটি ক্ষমতার ওপর ব্যাপকভাবে জোর দিচ্ছে। এমনকি ডিভাইসটিতে একটি ফিজিক্যাল ডায়াল ফিচারও আছে, যার মাধ্যমে বাস্তব পরিবেশে কী হচ্ছে, তা আপনি দেখতে ও বুঝতে পারবেন। ডিভাইসটির বাইরের দিকে একটি আলাদা পর্দাও আছে, যাতে যে কেউ আপনার দিকে তাকালে আপনার চোখ দেখতে পায়। এতে করে অন্য কারও সঙ্গে কথা বলার সময় আরও বাস্তব অনুভূতি তৈরি হয়।
ডিভাইসটি উন্মোচন অনুষ্ঠানে অ্যাপল একটি ভিডিও দেখায়, যেখানে কিছু বাচ্চা ফুটবল খেলছিল ও পাশেই ডিভাইসটি পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল তাদের বাবা। শিশুটি ফুটবলে কিক দিলে সেটি তার বাবার দিকে এগিয়ে আসে এবং তিনি ফুটবলটি ধরে ফেলেন। অ্যাপল প্রমাণ করতে চেয়েছে, ডিভাইট পরলেও বাস্তব দুনিয়া থেকে কেউ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না।
যদিও আক্ষরিক অর্থেই ডিভাইসটি আপনাকে পুরোপুরি মহাজাগতিক কোনো অবস্থায় নিয়ে যাবে না, তবে আপনার পুরো মনোযোগ সেই মুখের সঙ্গে লেগে থাকা ৬ ইঞ্চি স্ক্রিনেই আবদ্ধ থাকবে, এটা নিশ্চিত। আপনার হাতে থাকা কোনো ৬ ইঞ্চি স্ক্রিনের ডিভাইসের তুলনায় এটি অনেক বেশি নিঃসঙ্গ পরিস্থিতি তৈরি করবে। ধরুন আপনি একটি খুব মজার টিকটক দেখলেন। কীভাবে এই ডিভাইসের সাাহয্যে সেটি পাশের জনকে দেখাবেন? কিংবা বিড়ালের সুন্দর কোনো ভিডিও ক্লিপ সামনে আসলে কীভাবে আপনার পাশে থাকা বাচ্চা বা সঙ্গীকে দেখাবেন? আপনার আদরের বিড়ালটি আপনার কোলে এসে বসেছে, এটি কীভাবে ফেস টাইমিংয়ে যুক্ত সবাইকে দেখাবেন?
আপনি যখন একাকী থাকতে চান কিংবা সিনেমা দেখতে চান, তখন চোখের সঙ্গে একটি ডিভাইস লাগিয়ে একাকী হয়ে যাওয়া এক জিনিস। কিন্তু অ্যাপল শুধু আপনার মুখে সঙ্গে লেগে থাকা কোনো স্ক্রিন হিসেবে ডিভাইসটিকে বিক্রি করছে না। এটি পরিহিত অবস্থায় আপনি সব কাজ করতে পারবেন- বাসায় হাঁটতে পারবেন, ফ্রিজ থেকে পানি বা ফল নিয়ে খেতে পারবেন, সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন, মিটিং করতে পারবেন, কম্পিউটারে কাজও করতে পারবেন। এই ডিভাইসটিই একটি কম্পিউটার হিসেবে কাজ করবে।
আরো পড়ুন: মানব মস্তিষ্কে চিপ বসানোর অনুমতি পেল মাস্কের নিউরালিংক
সূত্র: দ্য ভার্জ
এম এইচ ডি/