বুধবার, ১৭ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২রা শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস, গ্রাম-বাংলার মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন যিনি

বিনোদন ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০২:৪৫ অপরাহ্ন, ১লা জুলাই ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

যাত্রাপালার রঙবাহারির দিন শেষ হয়ে গেছে সেই অনেক আগেই। যাত্রাপালা বা যাত্রাগান এখন প্রকৃতার্থে স্থবির, মৃতও বটে! বাংলা ও বাঙালির অন্যতম এই সাংস্কৃতিক ধারার এখন যতটুকু প্রাণ আছে সেখানেও রয়েছে নানান নিয়ন্ত্রণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন। সত্তর, আশির দশকের সেই আলোকজ্জ্বল যাত্রামঞ্চে হ্নদয় উৎফুল্ল করা সৌন্দর্যময় যাত্রাগান এখন অতীত স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর নতুন প্রজন্মের কাছে যাত্রাগানের কোনও আবেদন নেই। অবশ্য গ্রামের প্রৌঢ়, প্রবীণরা এখনও যাত্রাগানের স্মৃতির অবগাহনে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন অন্যরকম আত্মতৃপ্তি।

রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রয়ুক্তির নানান পরিবর্তনের ধারায় এই শিল্প মাধ্যম সত্যিই সংকটাপন্ন। কিন্তু এতসবের পরেও এই শিল্পকলার একটি নাম অমর, অক্ষয় এবং বিস্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি প্রয়াত অমলেন্দু বিশ্বাস। ‘যাত্রাসম্রাট’ হিসেবে যিনি অমরত্ব লাভ করে আছেন।

এই নামটি উচ্চারিত হলেই যাত্রাপিয়াসীদের মনে এক দৃঢ়চেতা অভিনেতার মুখচ্ছবি ভেসে আসে। এই নামের মধ্যেই রয়েছে হাজারও ঝলমলে রজনীর প্রাণময় গল্প। প্রাণবন্ত অভিনয়শৈলী দেখিয়ে যিনি দর্শকদের রাতজাগাকে স্মরণীয় করে দিতেন। এই বিস্ময়কর অভিনেতা এপার-ওপার দুবাংলাতেই ছিলেন সমান জনপ্রিয়।

মনকাড়া উপস্থাপন আর প্রাণকাড়া অভিনয় শৈলী দিয়ে যিনি যাত্রাপালাতে নতুন এক শক্তি, বোধ এবং নতুন ধারণা তৈরি করেছিলেন। সৃষ্টিশীলতায় মানুষটি অগ্রগণ্য। আর অভিনয় দিয়ে ভাঙতে চেয়েছিলেন বৈষম্যের জিঞ্জির। পৌরণিক আর ঐতিহাসিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে মানবিক বৈষম্য-বঞ্চনা আর অসহায়ত্ব কমিয়ে আনতে যাত্রামঞ্চকেই বেছে নিয়েছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর সমাজ পরিবর্তনের নির্মোহ উপলব্ধি তিনি ছড়িয়ে দিতেন যাত্রামঞ্চ থেকেই। যাত্রাজগতে নতুন নতুন সৃষ্টিতেও ছিলেন অদম্য। অভিনয় শৈলীতেও এনেছিলেন নতুনত্ব। আরও দৃঢ়, আরও কাব্যিক, আর সুর-ছন্দে সুষমায় পরিপূর্ণ-এমনতরো লক্ষ্য নিয়ে তিনি নিজেই নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সব ভেঙেচুরে ফেলতেন।

যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস সার্বিক অর্থেই আমাদের যাত্রামঞ্চের সর্বকালের সেরা এক মহানায়ক। কেননা তার অভিনয় দেখে দর্শকরা বাকরুদ্ধ হয়ে যেত। আর তাইতো গ্রামবাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে এই নামটি আলাপে আড্ডায় এখনও অন্যরকম সুরভী ছড়ায়। যে বা যিনি যাত্রামঞ্চে তার অভিনয় দেখেছেন তিনি কোনোদিন তাকে হ্নদয় থেকে আর মুছে ফেলতে পারেননি। তার কণ্ঠে প্রেম-বিরহ, মানবতা, শ্রমজীবী মানুষের দুঃখকথা, সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সামাজিক বৈষম্যচিত্র ফুটে উঠতো অন্যরকম এক শৈল্পিক চেতনায়। যাত্রাশিল্পকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়েছিলেন তিনি। তার সেই দৃঢ় কণ্ঠস্বর এখনও প্রতিধ্বণিত হয় সর্বত্র। টানা ২৬ বছর তিনি যাত্রামঞ্চে ছিলেন উচ্চকিত।

গত ২৯ মে ছিল তার ৯৮তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে স্মরণ করেছেন শত সহস্র জন। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেককেই দেখা গেছে এই বরেণ্য যাত্রাশিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে। কৈশরে-তারুণ্যে যাত্রামঞ্চে সরাসরি দেখা অমলেন্দু বিশ্বাসের সেই দুর্দান্ত অভিনয়কে স্মরণে এনে অনেকেই স্মৃতির সাগরে ভেসেছেন। আসলে তিনি কি শুধুই অভিনেতা ছিলেন, না আরও কিছু?

অমলেন্দু বিশ্বাসের স্নেহধন্য মাগুরার প্রবীণ যাত্রা শিল্পী সুজয় সাহা বললেন, ‘না তিনি কেবল অভিনয়ই করতেন না। অভিনয়ের বাইরে তার সামাজিক দায়বদ্ধতাও ছিল অনেক। সমাজের শ্রেণী ভেদাভেদ, বৈষম্য তিনি পছন্দ করতেন না। সাম্যবাদের গান তিনি গেয়ে গেছেন মৃত্যু অব্দি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মাগুরার ইছাখাদা, শত্রুজিতপুর, কাজলী, রাধানগর, নাকোল, রামনগর, লাঙ্গলবাঁধসহ এমন কোনো জায়গা নেই যে মঞ্চে ওঠেননি। বৃহত্তর যশোরসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোত উন্নয়নেও তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। কেননা সেসময় অবকাঠামোগতভাবে পিছিয়ে থাকা বেশিরভাগ স্কুল কলেজের উন্নয়নে যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। গুরু অমলেন্দু বিশ্বাসের অভিনয় এই উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কেননা তার অভিনয় দেখার জন্যইতো পুরো প্যান্ডেলে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো’।

উদাহরণ টেনে তিনি আরও জানালেন, মাগুরার শত্রুজিতপুরে যে উচ্চবিদ্যালয় রয়েছে এক অর্থে এটি অমলেন্দু বিশ্বাসের অভিনয়ের অবদান। উনি বেশ কয়েকবার বাবুল অপেরা নিয়ে এখানে এসেছেন। স্কুলের ফান্ড রেইজিং-এ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন। উনার অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

সুজয় সাহা জানান, স্বাধীনতার পর নড়াইলের স্মরণিকা অপেরার সাথে তিনি কাজ শুরু করেন। তখনই অমলেন্দু বিশ্বাসের সাথে তার পরিচয় ঘটে। যৌবনে সুজয় সাহা কিংবদন্তী যাত্রানট অমলেন্দু বিশ্বাসের সান্নিধ্যে এসেছেন একাধিকবার। আশির দশকে মাগুরাতে তার বাসায়ও গিয়েছেন অমলেন্দু বিশ্বাস। অমলেন্দু বিশ্বাসের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছেন। সেই সুমধুর স্মৃতি তিনি এখনও হ্নদয়ের অন্তস্থলে ধারণ করে আছেন।

অমলেন্দু বিশ্বাসের নাম উচ্চারণ করতেই তিনি বিনীত কণ্ঠে বলেন, ‘উনার অভিনয় আর ব্যক্তিত্বের সাথে কারও তুলনা হয় না। উনার আগুন ঝরা অভিনয়, ব্যক্তিত্ব, কথা বলার স্টাইল সবই ছিল অনন্য। এই একজনের নাম শুনলেই যাত্রা প্যান্ডেলে উপচে পড়া ভীড় হতো। কত মানুষ দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসতো উনার অভিনয় দেখার জন্য। সেই অভিনয়ের গল্পগুলো গ্রাম থেকে এখনও হারিয়ে যায়নি। গ্রামের মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন তিনি এখনও।’

সুজয় সাহা এখনও আছেন এই শিল্পের সাথে। বর্তমানে যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সুজয় সাহা আরও বলেন, অমলেন্দু বিশ্বাস অভিনয় ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। যাত্রার জ্বলজ্বলে আকাশে দু’টি তারা ছিল- অমলেন্দু বিশ্বাস আর জ্যোস্না বিশ্বাস। এমন ঐতিহাসিক প্রেমময় জুটি আর কোনোদিন যাত্রামঞ্চে দেখা যাবে না।

মৃত্যুঅব্দি যাত্রামঞ্চে অমলেন্দু বিশ্বাস ছিলেন অনন্য, অসাধারণ, অনবদ্য এক মহানায়ক। যে নায়কের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। যে নায়ক ছিলেন এদেশের গ্রামবাংলার প্রতিটি শিল্পপ্রেমী মানুষের হ্নদয়ের গভীরে প্রোথিত।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে গ্রামীণ সমাজে অমলেন্দু বিশ্বাস এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে সেই আশ্বিন মাস থেকেই সবাই তার দুর্দান্ত মনোমুগ্ধকর হ্নদয়কাড়া অভিনয় দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। গ্রামবাংলার মানুষ শুধু তার অভিনয় উপভোগ করতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ছুটে যেতেন। ‘অমলেন্দু বিশ্বাস’ নামটি যে ছিল ভীষণ আকর্ষণীয়!! এখনও তাই তিনি বিস্ময় জাগানিয়া, তিনি কিংবদন্তী।

শহরের বিত্তবান বা এলিট নয়, মূলত এখনও তিনি বড় বেশি উজ্জ্বল হয়ে আছেন আমাদের গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের হ্নদয়মন্দিরে। বাংলাদেশের যেকোন গ্রামের পৌঢ় বা প্রবীণকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন এই মানুষটার কথা- দেখবেন কেমন যেন নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গেছেন। হয়ত চোখের সামনে তার ভেসে উঠেছে চাটাই বা করগেটেড টিনে ঘেরা সেই আলোকজ্জ্বল যাত্রামঞ্চ। যেখানে দাঁড়িয়ে অভিনয় করছেন অমলেন্দু বিশ্বাস।

অমলেন্দু বিশ্বাস জনিপ্রয়তার শীর্ষে ছিলেন বহুবিধ কারণেই। খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে যে বুকের পাটা লাগে সেটি তার ছিল। প্রাণবন্ত পরিচ্ছন্ন সংলাপে তিনি মঞ্চ এতোটাই কাঁপিয়ে ফেলতেন যে মনে হতো মূল চরিত্রের মানুষটিকে তারা চোখের সামনেই দেখছে। এখানেই তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তার বিশ্বাসে, ভালোবাসায়, হ্নদয়ে, নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে ছিল অভিনয় আর অভিনয়। ‘মাইকেল মধুসুদন’ চরিত্রে তার অনবদ্য, অনন্য অভিনয় রীতিমতো ইতিহাস। তার মতো করে আর কেউ অভিনয় করতে পারবেন না-এটি সহজেই বলা যায়।

৭৩ সালে তিনি প্রথম ‘মাইকেল মধুসুদন’ যাত্রাপালা মঞ্চে নিয়ে আসেন। এই যাত্রাপালা সে সময় সর্বত্র এক মহা আলোড়ন তোলে। অভিনয় সুষমা দিয়ে মাইকেল চরিত্রটি তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তোলেন যে যাত্রাপ্যান্ডেলের দর্শকরা নির্বাক হয়ে যান। ‘লেনিন’, ‘হিটলার’ চরিত্রেও তিনি ছিলেন অসাধারণ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সত্তর, আশির দশকে বৈশ্বিক রাজনীতির কারণেই লেনিন, হিটলার ছিল আলোচিত চরিত্র। সেই চরিত্রকে একেবারে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যান বিস্ময়কর এই অভিনেতা। এখনও গ্রামে-গঞ্জে অনেকেই আড্ডায় আলাপে অমলেন্দু বিশ্বাসের প্রখ্যাত সংলাপগুলো আওড়িয়ে থাকেন। গ্রামে এখনও এরকম অনেক অভিনেতা আছেন যে যিনি অমলেন্দু বিশ্বাসের দু একটা সংলাপ বলে দিতে পারেন নির্বিবাদে। অমলেন্দু বিশ্বাসের অভিনয় জীবনের সার্থকতা এটিই।

আরো পড়ুন: ক্যাসিনো’ সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে - বুবলী

অমলেন্দু বিশ্বাসের জন্মদিনে তারই কৃতিকন্যা, গুণী অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস লিখলেন, ‘তুমি কি জানো কত ভালোবাসি তোমাকে? কতোটা শূন্যতা লাগে তোমায় ছাড়া? মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আছো, তোমার শরীরের গন্ধ পাই আমি।’

সত্যিইতো শ্রদ্ধেয় অমলেন্দু বিশ্বাস সুগন্ধ আর সুরভী ছড়িয়ে আছেন গ্রামবাংলার প্রতিটি ধূলিকণায়। তবে যাত্রামঞ্চের এই মহানায়কের সঠিক মূল্যায়ন কিন্তু হয়নি। বেদনার বিষয় জাতীয় বা অঞ্চলিক পর্যায়ে তার নামে কিছুরই নামকরণ করা হয়নি! অবশ্যই তার নামে এমন কোন স্মারকচিহ্ন করা উচিত-যাতে নতুন প্রজন্ম এই প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পারে। গবেষণা করতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।

ঢাকা বা চট্টগ্রামে তার নামে অবশ্যই একটি জাতীয় মঞ্চ বা মিলনায়তনের নামকরণ করে তার প্রতি ন্যূনতম সম্মান জানানো যেতে পারে।

এসি/ আইকেজে 


যাত্রাসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস

খবরটি শেয়ার করুন