ছবি: সংগৃহীত
-মাহফুজুর রহমান
ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেল সম্প্রতি ২৪ ক্যারেট খাওয়ার উপযোগী স্বর্ণের পাতে মোড়ানো জিলাপি বিক্রির ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পর কল্পনাতীত পরিমাণ ক্রেতা ছুটে যান স্বর্ণের জিলাপি কেনার জন্য। এই জিলাপির দাম ঘোষণা করা হয় কেজিপ্রতি ২০ হাজার টাকা। একজন গ্রাহক সর্বনিম্ন ২৫০ গ্রাম বা ৫ হাজার টাকার জিলাপি কিনতে পারবেন।
ব্যাপক চাহিদার মুখে স্বর্ণের জিলাপি বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ আর এই জিলাপির অর্ডারে নিচ্ছে না। কারণ হিসেবে তারা বলেছেন বিদেশ থেকে যে পরিমাণ খাওয়ার উপযোগী স্বর্ণের পাত আমদানি করা হয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। তাই আর জিলাপির অর্ডার নেওয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে ২০ হাজার টাকা কেজি মূল্যের জিলাপি কেনার জন্য এত ব্যক্তি আগ্রহী হবেন এবং অর্ডার দেওয়ার জন্য হোটেল পানে ছুটে যাবেন, তা হোটেল কর্তৃপক্ষও ভাবতে পারেনি। এ কারণে তারা কম পরিমাণে খাওয়ার স্বর্ণ আমদানি করেছিলেন।
পৃথিবীতে যে খাওয়ার জন্য স্বর্ণও আছে বা থাকতে পারে এটি আমরা অনেকেই জানতাম না, কল্পনাও করিনি। এবার জানলাম স্বর্ণ শুধু ভদ্রমহিলাদের অলঙ্কার বানানোর কাজেই ব্যবহার করা হয় না, খাওয়ার কাজেও ব্যবহার করা হয়। ডাক্তারদের অনেকেই রোগীদের আয়রন ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। আয়রন যদি খাওয়া যায় এবং তা শরীরের কাজে লাগে, তা হলে এত দামি স্বর্ণ তো খাওয়া যেতেই পারে; তাও শরীরের জন্য বিপুল উপকারী হতেই পারে। স্বর্ণ বলে কথা!
আলোচ্য হোটেল থেকে কী পরিমাণ স্বর্ণের জিলাপি বিক্রি হয়েছে এবং কারাই বা এর ক্রেতা ছিলেন- এসব কথা হোটেল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে না। এখানে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি তো পণ্যটির চাহিদা ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক। একটি পণ্য বাজারে ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেছে এবং এ তথ্য প্রচারিত হলে ভবিষ্যতে বাজার আরও ছড়িয়ে পড়বে এ কথা কে না জানে? এমন একটি নতুন ও উদ্ভাবনীমূলক পণ্য বাজারে এনে বিপুল সফলতা অর্জন করে হোটেলটি তো নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার কথা নয়।
একটি ফ্ল্যাট বিক্রি হলে আবাসন কোম্পানির মালিকরা ক্রেতা পরিবারের হাস্যোজ্জ্বল ছবি পত্রিকায় ছেপে প্রচারণা চালান, নতুন গ্রাহক ধরার চেষ্টা করেন। স্বর্ণের জিলাপি বিক্রির ক্ষেত্রেও একজন স্মার্ট ও সুন্দরী তরুণী বা একজন সুদর্শন যুবক ৩৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে শরীরটাকে মোচড় দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে জিলাপি খাচ্ছেন এমন ছবি পত্রিকায় প্রচার করতে পারত হোটেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব না করে স্বর্ণের জিলাপি বিক্রির ভবিষ্যতে কুঠারাঘাত করার হেতু কী? হোটেল কর্তৃপক্ষ এ প্রশ্নের জবাবে বলছে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ জিলাপি বিক্রি হয়েছে, তা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু একটি পণ্য তারা কী পরিমাণ বিক্রি করেছেন, সেটি বলার সুযোগ থাকবে না কেন? এ লুকোচুরিই তো সন্দেহের উদ্রেগ করে।
পত্রিকান্তরে জানা গেল, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম এ প্রসঙ্গে বলেছেন- এটি নিঃসন্দেহে সামাজিকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তিনি মনে করেন সমাজে যাদের হাতে প্রচুর অবৈধ অর্থ বা কালো টাকা রয়েছে, তারাই মূলত এ ধরনের বিলাসী খাবারের ক্রেতা ছিলেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেছেন, মানুষের শরীরে প্রাকৃতিক উপায়ে নানা ধরনের ধাতব পদার্থ রয়েছে- যেটি শরীরের জন্য খুব বেশি ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু কোনো খাবারের সঙ্গে এভাবে সরাসরি স্বর্ণের পাত যতই খাবার উপযোগী বলা হোক না কেন, এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর। জিলাপির সঙ্গে এ ধরনের স্বর্ণের ধাতব পদার্থ খেলে লিভার, ব্রেইন, কিডনি থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা হলে একটি হোটেলের পক্ষ থেকে মানুষকে স্বর্ণের পাত খাওয়ানো অপরাধ বলে গণ্য হওয়ার কথা এবং সরকার কর্তৃক হোটেলের বিরুদ্ধে উচিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
দেশের বহুল কষ্টার্জিত এবং বর্তমান সময়ে দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক একটি উপাদান আমদানি করাটাও অনিয়মের পর্যায়ে পড়ে।
করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ বেড়েছে। ব্যাপক সংখ্যক জনগণের আয় কমেছে, বেকার ও ছদ্মবেশী বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের হাতে টাকা নেই। উৎসবে কেউ বা খরচ করার বেলায় একটু সাবধানতা অবলম্বন করছেন, ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা ধরে রাখছেন।
সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকেই বলা যায়, সততার সঙ্গে পরিশ্রম করে অর্জিত টাকা ব্যয় করে কেউ এই স্বর্ণের জিলাপি খাবেন বলে মনে হয় না। অন্তত ক্রেতাদের বড় একটি সংখ্যা যে দুর্নীতির চাদরে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে, তা বলাই যায়। এ ক্ষেত্রে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই দুর্র্নীতিবাজদের তথ্য সংগ্রহ করার একটি সুযোগ নিতে পারত যদি ক্রেতাদের তালিকাটা সংগ্রহ করা যেত। তবে হোটেলটি হয়তো ক্রেতাদের ফোন নম্বরটি সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছে ভবিষ্যতে যোগাযোগ করার জন্য।
কিছুদিন পর হোটেলটি যদি আবার খাওয়ার উপযোগী বলে কথিত স্বর্ণ আমদানি করে, তা হলে এ গ্রাহকদের বিষয়টি সহজেই জানানো যাবে এবং ক্রয়াদেশ পাওয়া যাবে এরূপ আশায় তারা নিশ্চয়ই গ্রাহকদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহে রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ তদন্ত পরিচালনা করতে চাইলে হোটেল থেকে হয়তো ক্রেতাদের তালিকা পেয়ে যাবে।
ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধনী-গরিব থাকে- এটি স্বাভাবিক। পৃথিবীর বিভিন্ন ধনী দেশেও হতদরিদ্র মানুষ দেখা যায়। ব্রাজিল বা যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম নেই। আবার সেসব দেশে অতি ধনবানের সংখ্যাও অনেক। কিন্তু চারপাশে অভুক্ত বা হতদরিদ্র রোজাদার মানুষ থাকা অবস্থায় সেসব দেশে স্বর্ণখেকো মানুষ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
আরো পড়ুন: বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫.২ শতাংশ : বিশ্বব্যাংক
জিলাপি বাঙালি সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। নববর্ষে, ইফতারিতে, গ্রামীণ মেলায় ও বাঙালির অন্যান্য অনুষ্ঠানে ঘটা করেই জিলাপি পরিবেশন করা হয় এবং সবাই আনন্দ করে জিলাপি খান। তবে এই ঐতিহ্য গুড়ের জিলাপি ঘিরে, স্বর্ণের জিলাপিকে নিয়ে নয়। স্বর্ণের জিলাপি আমাদের চিরন্তন ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সাধারণ জিলাপিকে ভবিষ্যতে হেয় করে তোলে কিনা, যুবসমাজ কারণে-অকারণে স্বর্ণের জিলাপি নিয়ে মাতামাতি শুরু করে কিনা এগুলোও ভাবার বিষয়।
ঐতিহ্যবাহী মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের মতোই স্বর্ণের জিলাপি আমাদের ঐতিহ্য শিবিরে হানা দেওয়া আরেক শত্রু কিনা, তাও ভাবতে হবে। এসবের পাশাপাশি খাওয়ার উপযোগী স্বর্ণের পাত আমদানি করা দেশের আমদানি নীতি অনুসারে সিদ্ধ কিনা, তা দেখার দরকার। একই সঙ্গে খাওয়ার জন্য স্বর্ণের পাত বন্ধ করার নির্দেশনা প্রদানের এটিই উপযুক্ত সময়।
বলা হয়ে থাকে, মাছে-ভাতে বাঙালি। আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মাছ-ভাত খুব একটা আকর্ষণীয় বস্তু নয়। তারা ইউটিউবের সৌজন্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন স্বাদের খাবারের সঙ্গে নিত্যদিনই পরিচিত হচ্ছে। এগুলো তাদের প্রিয় খাবার। খাদ্যে বৈচিত্র্য আনতে আগ্রহী এই প্রজন্মের আগ্রহকে সম্বল করে স্বর্ণের পাতে মোড়ানো জিলাপি বাজারে আনা এবং তা বিক্রি নিয়ে একটা হইচই করে ফেলা আমার কাছে অনৈতিক বলে মনে হয়েছে।
স্বর্ণের জিলাপি খাওয়ার জন্য অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনকারীদের সন্তানরা তাদের আর্থিক অতিসচ্ছলতা জাহির করতে স্বর্ণের জিলাপি কেনার মতো একটি সুযোগ হাতছাড়া করবে না এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজের অন্য প্রজাতির অর্থাৎ সৎ, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ এবং তাদের সন্তানদের যদি মনের কোণে একবারও স্বর্ণের জিলাপি খাওয়ার বাসনা জাগে তা হলে কি তারা সেটি কিনতে পারবে? স্বর্ণের জিলাপির মাধ্যমে কি তা হলে মানুষের শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে এবং নির্মমভাবে মধ্যবিত্তদের প্রতি উপহাস করে চলেছে!
এসি/ আই.কে.জে/