প্রিয় সবুর স্যার,
আসসালামু আলাইকুম স্যার। অবশেষে আপনার কাছে লিখতে বসলাম। এভাবে লিখতে পারবো এটা কখনো ভাবিনি আমি। তবে অনেক ভেবেছি স্যার, আপনার কাছে আমার লিখা দরকার। সুযোগ পেলাম লিখার জন্য, তাই আপনার কাছে এই প্রথম লিখতে বসেছি। কিভাবে কী দিয়ে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তবে মনে পড়ছে সেই মাধ্যমিক স্কুল জীবনের কথা যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে স্যার আপনার সাথে আমাদের ক্লাস ছিলো না কিন্তু প্রায়ই চোখে পড়তো স্যার আপনি ৭ম শ্রেণীতে গণিত ক্লাস করাচ্ছেন। তখন দেখতাম যারা বাড়ির কাজ করে আনতো না বা ক্লাসে গণিত কষতে দিলে পারতো না সে যে কি মার মারতেন, তা দেখে আমার গা শিরশির করতো এবং প্রচণ্ড ভয় পেতাম।
ছোট বেলা থেকেই বেতের বাড়ি খুবই ভয় পেতাম। যার কারণে ক্লাসে প্রতিদিনই পড়া শিখে যেতাম। যাতে কোনও বিষয়ে বেতের বাড়ি খেতে না হয়। গণিতে আমি বরাবরই কাঁচা। কেন যেন গণিতটা মাথায় ধরে রাখতে পারতাম না। যার কারণে অংক মুখস্ত করতাম। মুখস্ত করে অংক পরীক্ষায় ক্লাস সিক্সে পেয়েছিলাম ৫০। তবে চেষ্টার কমতি ছিল না বাড়তি নাম্বার যেন পাই। তো ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে উত্তীর্ণ হয়ে সপ্তম শ্রেণীতে উঠলাম। যেদিন সপ্তম শ্রেণীর প্রথম দিন ক্লাস শুরু হলো, প্রথমে ছিলো বাংলা ক্লাস। ম্যাডাম কুশলাদি বিনিময় করে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে নতুন বইয়ে চোখ বুলিয়ে প্রথম গল্পটা বাসায় রিডিং পড়া দিলেন, বললেন গল্পটা এ টু জেড ভালো করে রিডিং পড়ে আসবে। তো প্রথম ক্লাস শেষ।
শুরু হলো ২য় পিরিয়ড। ২য় পিরিয়ডে স্যার আপনার সাথে ক্লাস মানে গণিত ক্লাস। স্যার প্রাথমিক পেরিয়ে যখন মাধ্যমিকে স্কুলে ভর্তি হলাম তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে আপনার সাথে আমাদের কোনও ক্লাস ছিলো না। কিন্তু স্যার আপনাকে প্রতিদিনই দেখতাম ও সালাম দিতাম।
আমার মনে পড়ে- স্যার, আপনাকে প্রথম দিন দেখেই আমার কেন জানি মনে হয়েছিল আপনি অনেক রাগী। মনে হলো যে ক্লাসে পড়া না পারলে স্যার হয়তো সেই শাস্তি (বেতের বাড়ি) প্রয়োগ করেন। তো সপ্তম শ্রেণীতে প্রথম দিনের ক্লাসে ২য় পিরিয়ডে স্যার আপনার সাথে ক্লাস। আপনি ক্লাসে ঢুকতেই কেন জানি আমার খুব ভয় করতে লাগলো। মনে হলো এই বুঝি স্যার আমাকে বেত মারবে। কিন্তু না তা হলো না।
স্যার ক্লাসে ঢুকেই আপনি সবাইকে সালাম দিলেন ও তারপর ছাত্রদের ছালামের উত্তর দিলেন। তারপর সুন্দর একটা হাসি দিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা সবাই কেমন আছো? আমাকে চেনো? আমাকে আজকের আগে তোমরা দেখেছো? কে কে আমাকে চিনো হাত তুলোতো! আমি সবার আগে হাত তুললাম। স্যার আমার কাছে এসে বললেন, তোমার নাম কি? তোমাদের বাসা কোথায়? আমি একে একে প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তারপর স্যার আপনি একে একে ক্লাসের সবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে সবাইকে বললেন, আজ শুধু আমরা গণিত বইটা সবাই এক নজর দেখি। ভিতরে কী কী অধ্যায় আছে সবাই এক নজর চোখ বুলাও। ইনশাআল্লাহ আমরা আগামীকাল থেকে গণিত কষা শুরু করবো। আমরা সবাই বই নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলাম। তারপর সময় শেষ হতে চললো। স্যার, আপনি বের হয়ে গেলেন।
পরবর্তী বিষয়ের শিক্ষক ক্লাস নেওয়ার জন্য আসলেন। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে স্যার আপনার চেহারা ভাসতে লাগলো। মনে হলো এই যেন স্যার বেতের বাড়ি দিবে। তো যাই হোক, ২য় দিন ক্লাস শুরু হলো। স্যার, আপনি গণিত বই খুলে ২/৩টা অংক করে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির কাজ দিলেন। বাড়ির কাজ করে নিয়ে গেলাম। ওরে বাপরে, স্যার আমাকেই আপনি বোর্ডে গণিত মিলানোর জন্য ডাক দিলেন। আমার হাত-পা থর থর কাঁপছে।
স্যার, আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন কি ব্যাপার? তুমি কি নার্ভাস? ভয় পাচ্ছ নাকি? বোর্ডে অংক করতে পারবে না? আমি মাথা নাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, স্যার চেষ্টা করি। আপনি বললেন, যাও “মা” বোর্ডে যাও- চেষ্টা করো, পারবে। বাসায় গিয়ে অংকগুলো ২/৩ বার কষেছিলাম এবং সেদিন বাড়ির কাজকর্ম ছিল। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে বোর্ডে গণিত করলাম। পরে ফলাফল মিলাতে পেরেছিলাম। স্যার আপনি মুচকি হেসে বললেন, এই যে খুকী ভয় পেলে চলবে? পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেতে হলে ভয় পাওয়া চলবে না। তারপর কী কারণে যেন স্কুল ৪/৫ দিন বন্ধ ছিলো।
বন্ধের পরে ক্লাসে গেলাম। স্যার, আপনি সকলের বাড়ির কাজের খাতা দেখতে লাগলেন আর সেদিনও বোর্ডে অন্য আরেক বান্ধবীকে যেতে বললেন অংক কষতে। কিন্তু সেই মেয়ে বাড়ির কাজও করেনি আর বোর্ডে অংকও কষতে পারলো না। স্যার, আপনি তো রেগে গেলেন এবং মেয়েটিকে বেত দিয়ে দুই হাতে ৫/৬টা বাড়ি মারলেন। মেয়েটি ফর্সা হওয়াতে বেতের বাড়িতে হাত লাল হয়ে গেলো।
বেতের বাড়ি খাওয়া দেখে আমি ভীষণ ভয় পেতাম এবং প্রতিদিনই অংক মুখস্ত করতাম যেন বোর্ডে গিয়ে ভুল না হয়। যাই হোক, সেদিন আমিও একটা বেতের বাড়ি খেলাম। অংক মিলাতে পারছি না এবং আমি চেষ্টা করেছি বাসায় রীতিমতো তা বুঝতে পেরে স্যার, আমাকে খুব জোরে না দিয়ে আস্তে একটি বেত মারলেন হাতে আর বললেন চেষ্টা চালিয়ে যাও। অংক মুখস্ত না করে বার বার অনুশীলন করবে এবং স্যার আমি খুব ভয় পাচ্ছি দেখে আপনি কাছে আসলেন আর বললেন, আমি জেনেছি, তুমি অন্যান্য বিষয়ের পড়া প্রতিদিনই মাশাআল্লাহ তৈরি করে নিয়ে আসো। না বুঝলে আমার কাছে থেকে বুঝে নিবে।
মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, নয়তো বেতের বাড়ি পড়বে। আমি বেতের বাড়ির ভয়ে প্রতিদিনই বাড়ির কাজ ঠিকমতো করে নিয়ে যেতাম। আর বেশি বেশি করে বাসায় অংক কষতাম। যাই হোক ৭ম শ্রেণী থেকে থেকে যখন ৮ম শ্রেণীতে উঠলাম গণিতে আমি পেলাম লেটার মার্কস। ৮৬ নম্বর পেলাম। আমার নম্বর দেখে আব্বা রীতিমতো অবাক। কেউ না জানুক, আমি জানি। স্যার, আপনার তদারকির কারণেই হয়তো আমি লেটার মার্কস পেয়েছিলাম এবং এসএসসিতে আলহামদুলিল্লাহ ৭৫ নম্বর পেয়েছিলাম।
স্যার, আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আপনি আমায় অনেক গণিত বুঝিয়েছিলেন। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে ভর্তি হলাম তখন একদিন স্যারের সাথে দেখা, স্যার বললেন কেমন আছো সুফিয়া? এখনো কি আমাকে ভয় পাও? তুমি তো অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। স্যার, আপনাকে তখন আর অতটা ভয় পেলাম না।
কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে বিয়ের পিড়িতে বসলাম। সংসার হলো। স্বামী ও সন্তানদ্বয় (দুই ছেলে) নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। স্যার দোয়া করবেন আমার ও আমার পরিবারের জন্য। আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য সবসময় দোয়া ও শুভকামনা।
একদিন দেখি ফেসবুকে স্যার আপনি আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। আমি এক্সেপ্ট করলাম। স্যার, মাঝে মাঝে ফেসবুকে আপনার পোস্ট দেখে খুব ভালো লাগে। আপনার পোস্ট দেখে অনুপ্রেরণা পাই। স্যার আপনি এখন বাংলাদেশের বাইরে থাকেন। আপনার মেয়েদের আমার খুব ভালো লাগে। আপুগুলো অনেক মেধাবী।
আজ অনেক দিন পর আপনার কাছে লিখতে বসে একের পর এক স্মৃতি মনে পড়ছে। লিখতে লিখতে এক অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে এবং চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কেন জানি না। হয়তো স্যার আপনাকে এখন আর ভয় পাই না, ভালোবাসি বলে। স্যার, আমার এই লেখা আপনি পড়বেন কি না জানি না, তবে আমি লিখতে পারছি আপনার কাছে এটাই আমার সার্থকতা।
সবশেষে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থনা, আপনি ভালো থাকবেন স্যার, আল্লাহ আপনাকে নেক হায়াত দান করুন ও সুস্থ রাখুন।
--- ইতি
আপনার ছাত্রী
সুফিয়া বেগম (সুফি)
আরও পড়ুন : প্রণতি জানাই এই সুন্দর পৃথিবীকে- পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
এস/ আই.কে.জে