বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা
সাম্প্রতিক সময়ে চীন অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা কঠিন সময় পার করছে। গত কয়েক মাসে বিশ্বে ভোক্তা দেশের শীর্ষ তালিকায় থাকা চীনের অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা পতনের আশঙ্কায় আন্তর্জাতিক পণ্যবাজারে শিল্প-জ্বালানিসহ কাঁচামালের দাম পড়ে যেতে দেখা গেছে। দেশে চীনা বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পেছনে এগুলোর সম্মিলিত প্রভাব থেকে থাকতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারি ভাষ্যমতে, ভূরাজনৈতিক বিচারে বাংলাদেশের অন্যতম মিত্র দেশ চীন। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আসার পর কৌশলগত সম্পর্ক আরো ব্যাপক মাত্রায় গতি পায়। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে নানা বড় অবকাঠামো নির্মাণে চীনা বিনিয়োগ আসতে থাকে।
পশ্চিমাদের সঙ্গে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক ও নীতিগত নানা প্রশ্নে বর্তমান দেশের সরকারের ভিন্নমত ও দূরত্বের কারণে চীনা বিনিয়োগ অনেকটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান নেয়া চীনের প্রকাশ্য ও মৌন সমর্থন পায় বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীনা বিনিয়োগ সহায়তার নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। এ সময় কিছু পরিমাণ অর্থছাড় হলেও তা ছিল মূলত আগে প্রতিশ্রুত বৃহৎ প্রকল্প ঋণের অর্থ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্যতম শীর্ষ অংশীদার দেশটি থেকে বিনিয়োগ কমে আসার পেছনে প্রভাবক হিসেবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই ধরনের বিষয়ই কাজ করে থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাদের ভাষ্যমতে, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন একপ্রকার অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগ নিয়ে কিছুটা সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে থাকতে পারেন চীনা বিনিয়োগকারীরা। আবার বাংলাদেশে রিজার্ভ সংকটসহ নানা কারণে এমনিতেই বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ রয়েছে। দেশে বিদ্যমান চীনা বিনিয়োগগুলো নিয়েই এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের আশঙ্কা।
ইআরডি, মার্কিন থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (এইআই) ও চীনা বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাংলাদেশে ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যার পরিমাণ ৩২৭ কোটি ডলার। ধাতু (নির্মাণসংশ্লিষ্ট) সরবরাহ খাতে দেশটির বিনিয়োগের পরিমাণ ২১৩ কোটি ডলার। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ১১০ কোটি ডলার। এছাড়া আর্থিক খাতে ১৬ কোটি ও অন্যান্য খাতে ৪১ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির।
সর্বশেষ গত বছরের জুনে দেশের জ্বালানি খাতে ১৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না জেনারেল টেকনোলজি। এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে পরিবহন ও জ্বালানি খাতে যথাক্রমে ২৪ কোটি ও ১২ কোটি ডলারের দুটি বিনিয়োগ এসেছিল। এ তিনটিই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের সর্বশেষ সামনে আসা তথ্য।
দেশে চীনা বিনিয়োগের গতি মন্থর হয়ে পড়ার পেছনে আসন্ন নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তার বড় ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে করছেন চীনঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদরা।
দেশে বিদ্যমান চীনা বিনিয়োগ এরই মধ্যে বেশ কঠিন সময় পার করছে। চালুর এক বছর পার হতে না হতেই চীনের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। ডলার সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি আমদানি নিয়েও মাঝেমধ্যেই বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে পরিচালনাকারী সংস্থাকে।
দেশে বিদ্যমান ডলার সংকট বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। আবার চীনের বিদ্যমান ঋণ বিনিয়োগ নিয়েও নানা সময়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো এসব ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহার ধার্য করে অন্যান্য উৎসের চেয়ে অনেক বেশি। ঋণের বোঝা বাড়ানোর পাশাপাশি তা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভেও বড় চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়াও বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগে গৃহীত প্রকল্পগুলোয় ঠিকাদারের কাজ প্রধানত চীনা সংস্থাগুলোই পেয়ে থাকে। আবার অন্যান্য দেশের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পেও চীনা ঠিকাদারদের আধিপত্য দেখা যায়। পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রেও মূল সেতু নির্মাণ ও নদী শাসনের কাজ করেছে দুই চীনা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনা ঠিকাদারের মাধ্যমে। দেশে চীনা ঠিকাদারদের কাজের ব্যাপ্তি এখন দেশটির মোট বিনিয়োগের কয়েক গুণে দাঁড়িয়েছে।
দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চীনের মোট বিনিয়োগের স্থিতি প্রায় ৭-৮ বিলিয়ন ডলার। আবার বিভিন্ন প্রকল্পে চীনা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পেয়েছে কমপক্ষে ২২ বিলিয়ন ডলারের।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে চীনের কোনো প্রতিশ্রতি ছিল না। তবে একই সময়ে বড় প্রকল্পে অর্থছাড়ের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
এসকে/
চীনের বিনিয়োগ বৈদেশিক বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ
খবরটি শেয়ার করুন