ছবি: সংগৃহীত
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেছেন, একাত্তর টিভির কারাবন্দী সাবেক সাংবাদিক ফারজানা রূপাকে জামিন দেওয়ার জন্য বাঙালি ও মুসলিম—দুই সংস্কৃতিই বিচারকের বিবেচনায় গুরুত্ব পাওয়া উচিত। নারীর ভূমিকা, বিশেষ করে সন্তান লালন-পালনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া রুপার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি। নারী ও প্রতিবন্ধীদের জামিন দেওয়ার জন্য আইনে বিশেষ বিধানও রয়েছে। রুপার বেলায় সেই মৌলিক মানবাধিকারেরই লঙ্ঘন হয়েছে, যেগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ বিগত আওয়ামী লীগের সরকারকে ২০২৪ সালে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
তিনি বলেন, অন্যায্যভাবে কখনো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বিচারকের সর্বোচ্চ ভূমিকা হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা বা হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনার অর্থ হলো, সরকার নিজেই আইনকে তুচ্ছ করছে। এর ফলে আসল অপরাধীরা আড়ালে থেকে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। মাহফুজ আনামের অভিযোগ, দেশে ভুয়া মামলা করার কোনো শাস্তি নেই এবং উল্টো এটা অর্থ উপার্জনের সুযোগ হয়ে উঠেছে, তাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা দায়েরের প্রবণতা দ্রুত বেড়েছে।
বর্তমানে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গণমাধ্যমকর্মী হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এতো সাংবাদিক হঠাৎ করে কীভাবে খুনি হয়ে গেলেন? আজীবন সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার জন্য গভীর লজ্জা ও অপমানের বিষয়। কারাবন্দী অন্য সাংবাদিক, যাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগপত্র গঠন করা হয়নি, সংবিধান অনুযায়ী জামিন তাদের অধিকার বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এই সরকারের আমলে গ্রেপ্তারকৃতদের কেন এখনো বিচার বিভাগ জামিন দিচ্ছে না এবং বিচার বিভাগ সেই স্বাধীনতা কেন দেখাচ্ছে না, প্রশ্ন রেখে প্রবীণ এই সম্পাদক বলেন, আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো নাগরিককে এক ঘণ্টার জন্যও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। বিচারক কি প্রশ্ন করতে পারবেন না যে হত্যা মামলার যুক্তি কী? একটি হত্যাকাণ্ডে কীভাবে কয়েকশ মানুষ অংশ নিতে পারেন? বিচারক কি প্রমাণ চাইতে পারবেন না? একজন বিচারক কেবল আইনি আমলা হতে পারেন না। তাদের হতে হবে নৈতিক, সাহসী ও নির্ভীক এবং আইন ও সংবিধানের রক্ষক।
'ক্যান জাস্টিস বি ডিসপেন্সেড ইন অ্যান আনজাস্টিস' (অন্যায্যভাবে কী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়) শিরোনামে ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারে লেখা এক উপসম্পাদকীয়তে তিনি এসব কথা বলেন। লেখাটি ডেইলি স্টারের ছাপা সংস্করণে গত শুক্রবার (১৯শে সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম লেখেন, 'নারী সাংবাদিক ফারজানা রূপা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগপত্র গঠন করা হয়নি। কেন তাকে জামিন দেওয়া হচ্ছে না? বাঙালি ও মুসলিম—দুই সংস্কৃতিতেই নারীর ভূমিকা, বিশেষ করে সন্তান লালন-পালনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামিন বিবেচনায় কি এই বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে যখন তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণই পাওয়া যায়নি? নারী ও প্রতিবন্ধীদের জামিন দেওয়ার জন্য আইনে বিশেষ বিধানও রয়েছে। এগুলো তো সেই মৌলিক মানবাধিকারেরই লঙ্ঘন, যেগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ বিগত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।'
প্রসঙ্গত, আদালতের কাছে স্বামীসহ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে এর মধ্যে আকুতি জানিয়েছেন একাত্তর টিভির সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপা। তার স্বামী একাত্তর টিভি থেকে চাকরিচ্যুত বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ। চলতি বছরের ২৭শে জানুয়ারি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুজ্জামানের আদালতে মিরপুর থানার এক মামলায় গ্রেপ্তারের শুনানিতে ফারজানা রুপা এ আকুতি জানান। শুনানিকালে আদালতের কাছে কথা বলার অনুমতি চান তিনি। বিচারক তাকে আইনের ভেতরে থেকে কথা বলতে অনুমতি দেন।
অনুমতি পেয়ে ফারজানা রুপা কাঠগড়ার সামনের দিকে এগিয়ে এসে সেদিন বলেন, আমার ছোট্ট শিশু সন্তান আছে। আমি আর আমার স্বামী দুজনই কারাগারে। ৬ মাস হয়ে গেছে। আমাকে জামিন দিন। আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে চাই। শুনানি শেষে আদালত সেদিন ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন। শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপাকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গত বছরের ২১শে আগস্ট। তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে আছেন।
দেশের অত্যন্ত সফল ইংরেজি পত্রিকা দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রকাশক মাহফুজ আনাম উপসম্পাদকীয়তে বলেন, বর্তমানে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গণমাধ্যমকর্মী হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এত সাংবাদিক হঠাৎ করে কীভাবে খুনি হয়ে গেলেন? আজীবন সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার জন্য গভীর লজ্জা ও অপমানের বিষয় বলে মনে করি। হ্যাঁ, আসামি হওয়া সাংবাদিকদের অনেককে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি, কিন্তু তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন, সুনামও নষ্ট হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার যদি এই নীতি গ্রহণ করত যে, ভুয়া মামলা করা অপরাধ এবং যারা এই অধিকারের অপব্যবহার করেছে তাদের শাস্তি দিত, তাহলে হয়রানি ও চাঁদাবাজির এই দ্বার খুলতো না এবং আইনের এতটা লজ্জাজনক, ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত অপব্যবহার হতো না। তিনি বলেন, 'আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো নাগরিককে এক ঘণ্টার জন্যও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। যখনই একজন বিচারক জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানান, তখনই তার বিবেকের ওপর ভারী বোঝা থাকা উচিত যে তিনি একজন নাগরিককে স্বাধীনতা ও স্বাভাবিক জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন।'
তিনি বলেন, 'বিচার বিভাগের অজুহাত হলো—যদি অপরাধটি জামিনের অযোগ্য হয়, তাহলে বিচারক কীভাবে জামিন দেবেন? কিন্তু এখানেই আসে ন্যায়পরায়ণতা ও বিবেচনার প্রশ্ন। বিচারক কি পরীক্ষা করবেন না যে সঠিক আইন প্রয়োগ হচ্ছে কি না? বিচারক কি প্রশ্ন করতে পারবেন না যে হত্যা মামলার যুক্তি কী? একটি হত্যাকাণ্ডে কীভাবে কয়েকশ মানুষ অংশ নিতে পারেন? বিচারক কি প্রমাণ চাইতে পারবেন না যে জামিনপ্রার্থী আসামি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন কি না? বিচারক চাইলে দু-একদিনের জন্য জামিন স্থগিত রাখতে পারেন এবং পুলিশকে প্রাথমিক প্রমাণ দিতে বলতে পারেন। প্রমাণ না পেলে তিনি নিজ বিবেচনায় জামিন দিতে পারেন। বিচারকের সর্বোচ্চ ভূমিকা হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।'
খবরটি শেয়ার করুন