বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাঁচটি ঝুঁকি আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে। ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনের আগে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে যে পাঁচটি ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো- জ্বালানি স্বল্পতা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি, সম্পদ ও আয়বৈষম্য এবং সরকারি ঋণ বেড়ে যাওয়া ও বেকারত্ব। বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতি আগেই সংকটের মুখে পড়েছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিতে ঝুঁকি আরও বাড়বে। বাড়বে মূল্যস্ফীতির হার।
ডব্লিউইএফ প্রকাশিত প্রতিবেদন প্রসঙ্গে সংস্থাটির অংশীদার হিসাবে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অবশ্য বলছে, ব্যবসায়ীদের ওপর করা এ জরিপে জ্বালানি সংকটই এখন প্রধান ঝুঁকি হিসাবে দেখা হচ্ছে। শিল্পকারখানায় এখন চাহিদার ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে গ্যাসনির্ভর শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যা উত্তরণে শিল্পকারখানায় রেশনিং করা হলেও স্থানীয়, বিশেষ করে এসএমই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছে না, যা এ শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। আবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এতে লেনদেনের ভারসাম্য থাকছে না।
আবার সম্পদ ও আয়ের মধ্যেও দেখা দিয়েছে বৈষম্য। সাধারণত উচ্চ আয়বৈষম্য থাকলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তেমন একটা বাড়ে না। কারণ মধ্যশ্রেণির ভোক্তারা হলেন সমাজের মূল ভোক্তা। তাদের আয় না বাড়লে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের গতি কমে যায়। কারণ সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের হাতে সম্পদ ও অর্থ জড়ো হলে তারা সেই অতিরিক্ত অর্থ দেশে বেশি ব্যয় না করে বিদেশে করেন। ফলে সমাজে এমন উচ্চবৈষম্য থাকলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়।
এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে যে অর্থায়ন প্রয়োজন, সেই নিরিখেও বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আর পঞ্চম ঝুঁকি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে সরকারি ঋণের কথা, যা বাড়লে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে। এ বিষয়টি ব্যবসায়ীরা অতীতে বারবার স্মরণ করিয়েছেন। তারা বাংলাদেশের প্রধান যে পাঁচটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছিলেন, সেগুলো ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণসংকট, উচ্চ পণ্যমূল্যের ধাক্কা, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি ও সম্পদের জন্য ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। ডব্লিউইএফের প্রতিবেদনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
মনে রাখতে হবে, শুধু ঋণ নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। এজন্য রপ্তানি ও বৈদেশিক আয় বাড়াতে হবে; অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। হুন্ডি বন্ধ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর পদক্ষেপ এবং ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়া স্বভাবতই কঠিন হবে। সমন্বিত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান মিলবে, এটাই প্রত্যাশা।
আই. কে. জে/