ছবি: সংগৃহীত।
ইমাম গাজ্জালী রহঃ
>> জন্ম-
ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪৫০ হিজরি সনে হুজ্জাতুল ইসলাম আবু হামেদ মোহাম্মাদ আল-গাজালী (রহ.) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোহাম্মাদ আল-গাজ্জালী। মহান দার্শনিক আলেমের প্রকৃত নাম ছিল মুহম্মদ। তবে তিনি হুজ্জাতুল ইসলাম উপাধি এবং ইমাম গাজ্জালী নামেই সকলের নিকট সুপরিচিত। 'গাজ্জাল' শব্দের অর্থ সুতা বিক্রেতা। তাই তার পারিবারিক উপাধি ছিল 'গাজ্জালী'।
মুহাম্মদের পিতা অর্থাৎ ইমাম গাজ্জালী -এর দাদার নাম ছিল আহমদ। তার পিতা মুহাম্মদ তখনকার সময়ে একজন স্বনামধন্য সুতা ব্যাবসায়ী ছিলেন।
>> শিক্ষাজীবন-
তার শিক্ষা জীবন ও বাল্যকাল কাটে তুস নগরীতে। ইমাম আল গাজ্জালি (রহ.) তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠতম ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির কাছে কয়েক বছর অতিবাহিত করেন। বাজারে যেসব বিদ্যার চাহিদা ছিল, তাতেও তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন। অতঃপর এ বস্তুকে নিয়ে তিনি ঠিক সেখানেই পৌঁছেন সেখানকার জন্যে এটি তৈরি হয়েছিল এবং তৎকালে একজন আলেম যতদূর উন্নতির কল্পনা করতে পারতেন, ততদূর তিনি পৌঁছে যান।
আবু হামিদ মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ আল-গাজ্জালি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই ইমাম গাজ্জালী হিসেবেই বেশি সুপরিচিত, মুহাম্মদের পিতা অর্থাৎ ইমাম গাজ্জালী-এর দাদার নাম ছিল আহমদ। তার পিতা মুহাম্মদ তখনকার সময়ে একজন স্বনামধন্য সুতা ব্যবসায়ী ছিলেন।
>> কর্মজীবন-
তিনি পরিণত বয়সে ৪৮৪ হিজরিতে বাগদাদ গমন করেন। বাগদাদে তৎকালীন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনায় যোগ দেন। মুসলিম দর্শন, ফিকাহ, ইলমুল কালাম (ধর্মতত্ত্ব) বিষয়ে তিনি সর্বকালের প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের একজন। ইমাম গাজ্জালীর আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রতি ছিল অগাধ তৃষ্ণা। নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা তার এই জ্ঞান পিপাসা নিবারণ করতে পারেনি। তাই অল্প সময়ের মধ্যে নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা ছেড়ে সৃষ্টি রহস্যের সন্ধানে তিনি পথে বেরিয়ে পড়েন। প্রায় দশ বছর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে অবশেষে আবার তিনি বাগদাদে তিনি তৎকালীন দুনিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় বাগদাদের নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকটর নিযুক্ত হন।
নেজামুল মুলক তুসী মালিক শাহ সালজুকী ও বাগদাদের খলিফার দরবারে যোগ্য আসন লাভ করেন। সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেন যে, সালজুকী শাসক ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দূর করার জন্যে তার খেদমত হাসিল করা হতো। পার্থিব উন্নতির এই পর্যায়ে উপণীত হবার পর অকস্মাৎতার জীবনে বিপ্লব আসে। নিজের যুগের তত্ত্বগত নৈতিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও তমুদ্দুনিক জীবনধারাকে যত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন, ততই তার মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে এবং ততই বিবেক তারস্বরে শুরু করে যে, এই পুঁতিগন্ধময় সমুদ্রে সন্তরণ করা তোমার কাজ নয়, তোমার কাজ অন্য কিছু।
অবশেষে সমস্ত রাজকীয় মর্যাদা, লাভ, মুনাফা, ও মর্যদাপূর্ণ কার্যসমূহেকে ঘৃণাভাবে দূরে নিক্ষেপ করেন। কেননা এগুলোই তার পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর ফকির বেশে দেশ পর্যটনে বেরিয়ে পড়েন। বনে-জঙ্গলে ও নির্জন স্থানে বসে নিরিবিলিতে চিন্তায় নিমগ্ন হন। বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মুসলমানদের সংগে মেলামেশা করে তাদের জীবনধারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। দীর্ঘকাল মোজাহাদা ও সাধনার মাধ্যমে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে থাকেন। ৩৮ বছর বয়সে বের হয়ে পূর্ণ দশ বছর পর ৪৮ বছর বয়সে ফিরে আসেন।
ইমাম গাজ্জালি (রহ:) ইসলামকে মধ্যযুগীয় অনৈসলামিক দার্শনিক চিন্তাধারার পঙ্গুকারী প্রভাব থেকে মুক্ত করে পবিত্র কোরআন-হাদিসের শিক্ষায় মুসলমানদের ফিরিয়ে আনেন। তাই তার এই অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তাকে ‘হুজ্জাতুল ইসলাম’ বা ‘ইসলামের রক্ষক’ বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: জ্ঞান, সাধনা ও সমর্পণের অনন্য দৃষ্টান্ত ইমাম গাজ্জালী
>> লেখনী ও বই-
ইমাম গাজ্জালি (রহ:) চারশ’র ও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার বইগুলোতে ধর্মতত্ব, দর্শন ও সুফিবাদ আলোচনা করেছেন। তার কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হল:-
০১. এহইয়া উলুমুদ্দীন,
০২. তাহাফাতুল ফালাসিফা,
০৩. কিমিয়ায়ে সা’আদাত,
০৪. হাকিকাতুর রুহু,
০৫. দাকায়েকুল আখবার,
০৬. আসমাউল হুসনা,
০৭. ফাতাওয়া,
০৮. মিশকাতুল আনোয়ার,
০৯. আসরার আল মোয়ামেলাতুদ্দিন,
১০. মিআর আল ইলম,
১১. মুনক্বীয,
১২. মুকাশাফা'তুল কুলুব
১৩. আল ইক্বতিসাদ ফিল ই'তিক্বাদ ইত্যাদি।
১৪. মিনহাজুল আবেদীন।
>> বাণী চিরন্তনী-
১. আমি আদব শিখেছি বেয়াদবের কাছে– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
২. আমার দোষ তুমি আমাকেই বল– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৩. মানবজীবনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তার ‘মন এবং জবানকে’ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে সমর্থ হওয়া– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৪. যদিও মানুষের হয়ত জ্ঞান রয়েছে, কিন্তু সেই জ্ঞান তাদের জন্য অর্থহীন যতক্ষণ তাতে বুদ্ধিমত্তার সংযোগ না ঘটবে– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৫. আপনি যা ভালোবাসেন তা অর্জন করতে হলে আপনাকে অবশ্যই আপনার অপছন্দের বিষয়টিতে ধৈর্যধারণ করতে হবে– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৬. দুনিয়াতে সবচেয়ে বোকা ও নির্বোধ সে, যে নিজের পবিত্রতা দাবী করে এবং নিজেই নিজের প্রশংসা করে– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৭. আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা যেন সেই শিশুটির মতন যে খুব ভালো করে জানে সে যদি মাকে না-ও ডাকে তবু মা তার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন এবং সঠিকভাবেই তার দেখাশোনা করছেন– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৮. আল্লাহ তা’আলা জুলুম-অত্যাচারের কারণে যেমন হাজ্জাজের প্রতিশোধ নিবেন, তেমনি হাজ্জাজের প্রতি কেউ জুলুম বা যবান-দরাযী করলে সেটারও বিচার করবেন– ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
৯. তিনটি অভ্যাস মানুষের কল্যাণ ডেকে আনে-
ক) আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা,
খ) বিপদের সময় দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া,
গ) যে কোনো সংকটে ধৈর্য ধারণ করা- ইমাম গাজ্জালী (রহ.),
১০. শক্ত কথায় রেশমের মতো নরম অন্তরও পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়- ইমাম গাজ্জালী (রহ.)
>> মৃত্যু-
এই মহামনীষী খ্রিষ্টাব্দ ১১১১ সনের ডিসেম্বর মাস মোতাবেক ৫০৫ হিজরি সনে নিজ জন্মভূমি তুস নগরীতে সুস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মৃত্যুর দিন ভোর বেলায় তিনি ফজরের নামাজ আদায় করেন এবং তার ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নিজ হাতে কাফনের কাপড় পরিধান করেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েন। এভাবেই এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই মহান দার্শনিক। ইরানের অমর কবি ফেরদৌসীর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
এমএইচডি/ আই. কে. জে/
খবরটি শেয়ার করুন