ছবি: সংগৃহীত
ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ টাঙ্গাইল জেলা। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথা জানে সবাই। শুধু নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। প্রায় ২০০ বছরের খ্যাতি ধরে রেখেছে টাঙ্গাইলের চমচম। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে অতুলনীয় স্বাদের কারণে বিদেশেও যাচ্ছে এই চমচম। দেশের বিভিন্ন জেলাতেও যাচ্ছে প্রতিদিন ২-৪ হাজার কেজি চমচম।
ইতিহাস বলছে- দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
এর আগে ১৬০৮ সালে পোড়াবাড়ি গ্রামটিকে নদীবন্দর হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সে সময়কালে ধলেশ্বরীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র পোড়াবাড়ি বাজার। তখন পোড়াবাড়ি ঘাটে ভিড়তো বড় বড় সওদাগরি নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার। এ বাজারে যোগ হয় সুস্বাদু চমচম, গড়ে ওঠে মিষ্টির বাজার। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। তবে এখন পোড়াবাড়ী নয়, মিষ্টি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনি বাজার।
পোড়াবাড়ির মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মধ্যে মৃত খোকা ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার ও টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ি মিষ্টি ঘরে এখনও নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়। এই পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। আর যেখানে চমচমের জন্ম সেই পোড়াবাড়িতে এখন রয়েছে হাতেগোনা মাত্র চার থেকে পাঁচটি মিষ্টির দোকান।
সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা। চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চমচম একটি উপাদেয় মিষ্টান্ন, যা যে কোনও বয়সের লোকের কাছে লোভনীয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, পূজা, জন্মদিনে, পরীক্ষায় ফলাফল, চাকরির প্রমোশন, নির্বাচনে জয়ী, নতুন চাকরি, শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার সময় এই চমচম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় এখনও সর্বমহলে প্রচলিত রয়েছে।
শহরের পাঁচআনি বাজারের প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন তৈরি হয় পোড়াবাড়ির চমচম। বেশিরভাগ দোকানের মালিক নিজেরাই এ চমচম তৈরি করেন। আবার তাদের কাজের সহায়তার জন্য রয়েছে একাধিক সহযোগী। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়।
টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, ‘আমার বাবা খোকা ঘোষ ১৯৩৯ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। সেখান থেকে আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। আমার পরের প্রজন্ম আমার ছেলেও আছে। মূলত এই পোড়াবাড়ির চমচমের উৎপত্তি হয়েছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে।’
চমচম এখনও কেন এত জনপ্রিয়, সে তথ্য জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা মফিদুল ইসলাম ও হাবীব বলেন, ছোট বেলায় দেখেছি হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। এখনতো প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান হয়েছে। সে সময়রে মিষ্টির স্বাদ ও বর্তমানে যে স্বাদ তাতে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
কিন্তু মিষ্টির গুণগত মান আগের তুলনায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় পোড়াবাড়ির চমচম অনেক সুস্বাদু। দীর্ঘ পরিক্রমায় এখনও সেই সুনাম ধরে রেখেছেন চমচম ব্যবসায়ীরা।’
আরো পড়ুন: গাছের বয়স ৫ হাজার বছর!
চমচমের স্বাদ ও মান বিষয়ে স্বপন ঘোষ বলেন, চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে- চরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর জলেরও একটা বিষয় আছে। দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয়। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। মিষ্টি তৈরিতে কোনও ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। এসব কারণেই চমচম বিখ্যাত হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। তবে তৎকালীন সময়ে মিষ্টির যে ফ্লেভার ছিল, সেটা বর্তমানে নেই। আমরা চেষ্টা করছি আগের স্বাদ ধরে রাখতে। তারপরও টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির মিষ্টির চেয়ে কোথাও আর ভালো মিষ্টি তৈরি হয় না।’
জয়কালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পরিচালক সমীর ঘোষ বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ থেকে মিষ্টি ব্যবসায় নিয়োজিত। এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য। এজন্য আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। সারাদেশে আমাদের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিনশ’ টাকায়। মান ও গুণগতভাবে আমাদের মিষ্টি অন্যান্য দোকানের চেয়ে ভিন্ন। এজন্য বিক্রিও হচ্ছে বেশি।’
গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডারের কর্ণাধার দ্বীপ দাস বলেন, ‘মান ও গুণগতভাবে আমাদের মিষ্টির সুনাম রয়েছে। এই মিষ্টির টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য বহন করে। তাই আমরাও সেই ঐতিহ্য রক্ষায় মিষ্টির মান অনেক ভালো করি।
মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চিনির দাম বেড়ে গেছে। আর প্যাকেট ছাড়া মিষ্টির ওজন দিতে হচ্ছে। এজন্য মিষ্টির দাম কিছু বাড়ানো হয়েছে। এখন প্রতি কেজি মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে তিনশ’ টাকায়। প্রতি কেজিতে থাকে ১৩ থেকে ১৪ পিস করে মিষ্টি।’
বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন। টাঙ্গাইলের মোদক উপাধি প্রাপ্তরাও মিষ্টি শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
এসি/আইকেজে