প্রতীকী ছবি
সম্প্রতি দেশে বিষপান, বা অন্যান্য উপায়ে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। এসব আত্মহননের পেছনের গল্প তেমনভাবে উন্মোচন হচ্ছে না। গণমাধ্যমের খবর, শুধু রাজশাহীতেই একদিনে পৃথক ঘটনায় নারী-শিশুসহ ১০ জন বিষপান করেছেন। এর মধ্যে দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে।
গত ৪৮ ঘণ্টায় দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এসব ঘটনা ঘটে। তাদের মধ্যে আটজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার (২৭শে ফেব্রুয়ারি) থেকে শনিবার (১লা মার্চ) পর্যন্ত বিষপানে অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে। এসব ঘটনায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে তিনজন ও দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মৃত দুই নারী হলেন- উপজেলার পাইকড়তলী গ্রামের ওয়াশিমের স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম (২৫) ও তেবিলা গ্রামের রন্টুর স্ত্রী তাহমিনা আক্তার (৩০)। এর মধ্যে জান্নাতুন শনিবার (১লা মার্চ) দুপুরে আর শুক্রবার (২৮শে ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে তাহমিনা চিকিৎসাধীন অবস্থায় রামেক হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় দুর্গাপুর থানায় আলাদা দুটি অপমৃত্যুর (ইউডি) মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত ৪৮ ঘণ্টায় উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কীটনাশক পান করা রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হন। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই নারীর মৃত্যু হয়। এখনও পাঁচজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে তাদের শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে। দুর্গাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইব্রাহিম আলি বলেন, ‘বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করায় ও মৃত্যুর ঘটনায় থানায় দুটি অপমৃত্যুর (ইউডি) মামলা হয়েছে। বিষয়গুলো তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত অপরাপর রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আগে নারীদের মধ্যে প্রবণতা বেশি দেখা গেলেও পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার এখন অনেক বেশি। ডাক্তার বা চিকিৎসকরা আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করেন। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে ‘এক ধরনের অপরাধ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও আত্মহত্যার মতো ঘটনা বাড়ছে। প্রতিবছর প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র মতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? অনেকে মনে করেন, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন-হতাশা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা, বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতা। সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, বা হ্রাস পাওয়া এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতাও আত্মহত্যার প্ররোচনায় ভূমিকা পালন করে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্যদের ‘বোঝা’ হওয়ার অনুভূতিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক জীবনের চাপ; যেমন- পরিবারের সদস্য বা বন্ধুকে হারানো, চাকরির ক্ষতি বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (যেমন একা বেঁচে থাকা) আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। যারা বিয়ে করেনি, তারাও আরও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রহসন বা কুসংস্কার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেউ কেউ নিজের জীবন নিতে পারে। শৈশবের যৌন নির্যাতন এবং সৎ পিতা-মাতার যত্নে লালিত-পালিত হওয়ার ফলেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আত্মহত্যায় যৌন নিপীড়ন সামগ্রিক ঝুঁকির মধ্যে প্রায় ২০ ভাগ অবদান রাখে বলে বিশ্বাস করা হয়।
এছাড়াও আত্মহত্যার ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত ‘দারিদ্র্য’। আপেক্ষিক দরিদ্রতা বৃদ্ধি একজন ব্যক্তির চারপাশে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। ভারতে বেশি কৃষক মৃত্যুবরণ করেন আত্মহত্যার কারণে। চীনে আত্মহত্যার হার নগরের চেয়ে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিন গুণ বেশি। দেশটির এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমস্যাকেই এর কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়।
বর্তমানে মিডিয়া, যার মধ্যে রয়েছে ইন্টারনেট, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আত্মহত্যার বিবরণটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তখন, যখন তার সঙ্গে উচ্চ-ভলিউম, পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজ এবং আত্মহত্যার প্রশংসা বা রোমান্টিসাইজ করা হয়। যখন একটি নির্দিষ্ট উপায়ে কী করে নিজেকে হত্যা করা যায়, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়।
রাজশাহীতে বিষপানে যারা আত্মহত্যা করেছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, তার পেছনে কী কারণ আছে, তার সঠিক তদন্তের প্রয়োজন আছে। একই সঙ্গে কোন প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা ঘটেছে, কিংবা এসব আত্মহত্যার পেছনে কারো প্ররোচনা আছে কী না, তা-ও তদন্ত করে বের করা প্রয়োজন। অনেক সময় সঠিক তদন্ত ও পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ভুলের কারণেও অনেক হত্যাকাণ্ড আত্মহত্যা হিসেবে প্রচারে আসে।
বিষপান কী তারা নিজেদের ইচ্ছায় করেছেন, নাকি অন্তরাল থেকে কেউ বাধ্য করিয়েছেন, তাও খুঁজে বের করতে হবে। কারণ, অনেক অপরাধী এখন পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অনেক গৃহবধূর বেলায় এ রকম নৃশংস ঘটনা অতীতেও উন্মোচিত হয়েছে।
তাই পৃথক স্থানে ও পৃথকভাবে সংগঠিত হলেও দশজন নারী-শিশুর একযোগে বিষপানের নেপথ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কী না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে হবে। সর্বোপরি এসব ঘটনা ও এই প্রবণতা নিরসনে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের যারা অভিভাবক আছেন, তারাও তাদের প্রিয় সন্তানদের গতিবিধি এবং আচার-আচরণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
কেসি/এইচ.এস